মহামারি করোনায় টালমাটাল রাজশাহী অঞ্চলের আম-বাণিজ্য। বাইরে থেকে ক্রেতা না আসায় টানা দ্বিতীয় বছরের মত দাম নেই আমের। ফলে লোকসানের বৃত্তে আটকে আছেন রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোরের আম চাষি ও বাগান মালিকরা।

অথচ করোনার আগেও আমে চাঙ্গা ছিল এই অঞ্চলের অর্থনীতি। অধিক লাভ পাওয়ায় বেড়েছিল বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ। গত বছর সুপার সাইক্লোন আম্ফানে অন্তত ১৫ শংতাশ আমের ক্ষতি হয়। তার ওপরে ছিল করোনার থাবা। এবার মৌসুমজুড়ে ছিল না কোনো প্রাকৃতিক দুযোর্গ, ফলনও বেশ ভালো হয়েছিল। ক্ষতি কাটিয়ে এবার আমে লাভের আশা করছিলেন চাষি ও বাগান মালিকরা। কিন্তু আমের মৌসুমের শুরুতে আঘাত হানে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। 

শুরুতেই চাঁপাইনবাবগঞ্জে ধরা পড়ে করোনার ভারতীয় ধরণ। সংক্রমণ ঠেকাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাজুড়ে দেওয়া হয় জোনভিত্তিক লকডাউন। ফলে জমতেই পারেনি দেশের সবচেয়ে বড় আমের হাট কানসাট আমবাজার।  

মৌসুমি আম-বাণিজ্যের কথা ভেবে প্রথমে কিছুটা পেছালেও পরে রাজশাহীতেও জোনভিত্তিক লকডাউন দেয় প্রশাসন। ফলে নগরীর উপকণ্ঠ বানেশ্বর আমের হাটও হয়ে পড়ে টালমাটাল। দেশের অন্যতম এই হাটে আম উঠলেও বাইরের ক্রেতা ছিল না। ফলে পানির দামে আম বিক্রি হয়েছে। প্রায় একই চিত্র নওগাঁর সাপাহার আমবাজারেরও। আমে ঠাসা এই বাজারে আম কেনার লোক নেই।  

মাঠ প্রশাসন ও কৃষি দফতর জানাচ্ছে, লকডাউনের আওতার বাইরে রাখা ছিল আম সংগ্রহ, পরিবহন ও বাজারজাত। বাজার বসানোর ঘোষণা ছিল খোলা মাঠে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রেতা-বিক্রেতাদের বাজারে আসতে বলা হয়েছিল। ঘোষণা মেনে সবই হয়েছে, কিন্তু কাঙিক্ষত ক্রেতা পাওয়া যায়নি। বাইরের ক্রেতারা না আসায় স্থানীয় ক্রেতারা ও আড়তদাররা পানির দরে আম কিনে বাইরে পাঠিয়েছেন। আম চাষি ও বাগান মালিকদের লাভের অংশ চলে গেছে তাদের পকেটেই।  

রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এই বছর গড়ে প্রতি টন আমের দাম পাওয়া গেছে প্রায় ২৫ হাজার টাকা। গত বছর এক টন আমের দাম মিলেছে ৩০ হাজার টাকার মত। এ বছর ভরা মৌসুমে প্রতি মণ গুঁটি আম বিক্রি হয়েছে ৮শ থেকে ১১শ টাকায়। গেল বছরের একই সময়ে গুঁটি আমের দাম ছিল ৮শ থেকে দেড় হাজার টাকা। এই বছর গোপালভোগ আম বিক্রি হয়েছে ১৮শ থেকে ২২শ টাকা মণ দরে। গত মৌসুমে চাষি ও বাগান মালিকরা গোপালভোগের দাম পেয়েছেন ২৪শ থেকে ২৬শ টাকা। এই বছর ল্যাংড়া ১৪শ থেকে ১৭শ এবং লক্ষ্মণভোগ ৭০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে গত বছর ল্যাংড়া ১৮শ থেকে ২ হাজার টাকা এবং লক্ষণভোগ ৮শ থেকে ১২শ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

কৃষি দফতরের হিসেবে, বাগান থেকে প্রায় ৯২ শতাংশ আম নেমে গেছে। এখনো রয়েছে অন্তত ৮ শতাংশ আম। এর মধ্যে ফজলি, আম্রপালি, বারি-৪ ও আশ্বিনা উল্লেখযোগ্য। এখনকার বাজারে প্রতি মণ আম্রপালি বিক্রি হচ্ছে ২২শ থেকে ২৪শ টাকায়। গত বছর একই সময়ে আম্রপালি বিক্রি হয়েছে ২৯শ থেকে ৩৪শ টাকা মণ দরে। এছাড়া ফজলি ২২শ থেকে আড়াই হাজার, বারি-৪ ২৮শ থেকে ৩২শ এবং আশ্বিনা ৮শ থেকে ১২শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মৌসুমের একেবারে শেষ সময়ে এসে আমের কিছুটা দাম পাচ্ছেন চাষিরা। অঞ্চলভেদে আমের দামে কিছুটা হেরফের হচ্ছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বোয়ালিয়া এলাকার মৌসুমি আম ব্যবসায়ী ওবাইদুল্লাহ বিন সাঈদ মাদানী। প্রতি বছরই তিনি মৌসুমের শুরুতে আমবাগান কেনেন। এই বছর তিনি ৪০ বিঘা আমবাগান কিনেছিলেন। বাগান থেকে ৭০ মণ ল্যাংড়া, ৩০ মণ ক্ষিরসাপাত ও গোপালভোগ এবং ২০ মণ ফজলি আম পেয়েছেন। প্রতিমণ ল্যাংড়া ১১শ, ক্ষিরসাপাত ও গোপালভোগ ১২শ, এবং ফজলি ৬শ থেকে ৮শ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। লাভ তো দূরের কথা, এই মৌসুমে তিনি প্রায় এক লাখ টাকা লোকসান গুনেছেন। 

একই দশা নাটোরের মৌসুমি বাগান মালিক আফসার আলীরও। তিনি জানান, ১০ লাখ টাকায় কয়েকটা আমবাগান কিনেছিলেন। টানা লকডাউনের কারণে আম বাইরে পাঠাতে পারেননি। কিছু আম বাগানেই নষ্ট হয়েছে। লাভ তো হয়নি বরং কোনোরকমে আসল টাকা তুলতে পেরেছি। আগামীতে আমবাগানে বিনিয়োগের বিষয়টি তিনি ভেবে দেখবেন বলেও জানান। 

আমের বাম্পার ফলন হওয়ায় দাম নেই বলে উল্লেখ করেছেন নওগাঁর সাপাহারের প্রান্তিক আম চাষি নওশাদ আলী। তিনি জানান, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকায় এ বছর আমের ফলন ভালো হয়েছে। বাজারে আমের ছড়াছড়ি। কিন্তু কেনার লোক নেই। তবে এলাকার অধিকাংশ আমবাগানে আম্রপালি ও বারি-৪ জাতের আম রয়েছে। ফলে মৌসুমের শেষ দিকে এসে আমের ভালো দাম পাচ্ছেন চাষিরা। তাতে কিছুটা হলেও ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন। 

তবে উল্টো চিত্র আমের রাজধানীখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জে। আম চাষিরা বলছেন, জেলার অধিকাংশ আমবাগান পুরোনো। এখানে ক্ষিরসাপাত, গোপালভোগ, ল্যাংড়া, লক্ষ্মণভোগ, ফজলি এবং আশ্বিনা জাতের আম চাষ হয়। এসব আমের দাম নেই এ বছর। ভালো ফলন হলেও লকডাউনের কারণে বাইরের ক্রেতারা সেভাবে আসতে পারেননি। এই কারণেই আমের কাঙ্ক্ষিত দাম মেলেনি এবার। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট আমবাজারের ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম জানান, কানসাট আম বাজারের সিংহভাগ ক্রেতা ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার। স্থানীয়ভাবে লকডাউন থাকায় বাইরের ক্রেতারা বাজারে আসতে পারেননি। ফলে আমের দাম পাননি চাষি ও বাগান মালিকরা। 

কয়েক বছর আগেও আমচাষ লাভজনক ছিল বলে জানিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার আম চাষি ও ব্যবসায়ী মশিউর রহমান। তিনি বলেন, এখন বাজারে প্রতি মণ আশ্বিনা আমের দাম পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৪০০ টাকা। তারপরও ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। গাছেই নষ্ট হচ্ছে আম। অথচ বছর কয়েক আগেও ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা মণে তারা আশ্বিনা আম বিক্রি করেছেন। আম চাষে তাদের এখন আর লাভের আশা নেই।

রাজশাহীর আঞ্চলিক কৃষি দফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১১-২০১২ মৌসুমে রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় মোট ৪২ হাজার ৪১৭ হেক্টর জমিতে আমবাগান ছিল। গত ২০১৯-২০২০ মৌসুমে এই অঞ্চলে আমবাগান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৬ হাজার ২৮৬ হেক্টর। ২০১১-২০১২ মৌসুমে এই চার জেলায় আম উৎপাদন ছিল ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৭৩ টন। ২০১৯-২০১০ মৌসুমে তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৭৫ হাজার ৬৯৮ টনে। 

চলতি ২০২০-২০২১ মৌসুমে রাজশাহীতে ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে। এছাড়া নওগাঁয় ২৫ হাজার ৮৫০ হেক্টর, নাটোরে ৫ হাজার ৮৫৭ হেক্টর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে। চলতি মৌসুমে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে- রাজশাহীতে ২ লাখ ১৪ হাজার ৪৮৩ টন, নওগাঁয় ৩ লাখ ২০ হাজার টন, নাটোরে ৭৬ হাজার টন এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২ লাখ ৫০ হাজার টন।

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিম উদ্দিন জানান, দীর্ঘদিন ধরেই এই অঞ্চলের কৃষকরা ধানের নায্যমূল্য পাচ্ছেন না। আর এ কারণে কৃষক ঝুঁকছেন বাণিজ্যিক বাগানে। তাছাড়া আমের উচ্চ ফলনশীল ও উন্নত জাত এসেছে। এসেছে হাইব্রিডসহ নানা আমের জাত। ফলে এখন আর অন ইয়ার বা অফ ইয়ার নেই। আমের ফলনও বেড়েছে কয়েকগুণ।

আরএআর