শীতলপাটিতে দুঃখ বোনে ৪৫ পরিবার
বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের কাঁঠালিয়া গ্রামে পা রাখতেই দুই পাশে দেখা মিলল বড় বড় পাইত্রা বা মোর্তাগাছের ঝোপ। বাড়ির আঙিনা, পরিত্যক্ত ফসলি জমি, পুকুরপাড়― সব জায়গাতেই বর্ষজীবী উদ্ভিদ তরতাজা পাইত্রাগাছ মাথা তুলে আছে। গ্রামীণ জনপদের আভিজাত্যের স্মারক শীতলপাটি তৈরি হয় এই পাইত্রাগাছের বেতি দিয়ে।
জানা যায়, কাঁঠালিয়া গ্রামে পাইত্রাগাছের আবাদ হয়েছে গ্রামের গোড়াপত্তনের শুরুতে। আর গ্রামটি ঠিক কবে গোড়াপত্তন হয়েছে, তা এখনকার বাসিন্দারা জানেন না। তাদের পূর্বপুরুষরা যে পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, আজও সেই পেশা ধরে রেখেছেন উত্তর পূরুষ কাঁঠালিয়াবাসী। এক গ্রামে টিকে আছে ৪৫ পরিবারে প্রায় ৩২০ জন বাসিন্দা। সবার পেশাই শীতলপাটি বুনন। ফলে ইউনিয়নের কাঁঠালিয়া গ্রামটি দলিল-দস্তাবেজে পরিচিত থাকলেও মুখে মুখে ‘পাটিকর গ্রাম’ নামে সমধিক পরিচিত।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে গ্রামে দেখা গেল, বর্ষা আর লকডাউনের বিধিনিষেধে ঘরবন্দি মানুষ ব্যস্ত পাটি তৈরির কাজে। ঘরের বারান্দা, মেঝেতে পরিবারের ছোট সদস্যটি বাদে সবাই হাত লাগিয়েছেন পাটি বুননে। যদিও এক দশক আগে শীতল পাটি ছিল কুটিরশিল্পের আভিজাত্যের পরিচয়।
তবে প্লাস্টিক পণ্যের ছড়াছড়িতে সেই শিল্প এখন ধুঁকে ধুঁকে মরছে। অনেকে শীতলপাটির কাজ ছেড়ে প্লাস্টিকের পাটি ফেরি করে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সেই সংখ্যা নেহাত কম। তবে পাটিকররা উদ্বিগ্ন; পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের প্রতীক শীতলপাটি বিলীন হয়ে যাবে।
কথা হয় চন্দন পাটিকরের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিবারের ৬ সদস্য মিলে একটি পাটি তৈরি করি। প্রতিজনে দৈনিক মজুরি ২৫ টাকা করেও আসে না। তারপরও করার কিছু নেই; বাপ-দাদার পেশা হিসেবে এখনো শীতলপাটি বুনে যাচ্ছি। এখন কেমন আছেন, উত্তরে বলেন, পেটেভাতে আছি। শীতলপাটি বুনে এখন আর লাভ নেই। বাপ-দাদারা এই পেশায় থেকে আমাদেরও অশিক্ষিত রেখে গেছেন; আমাদের ছেলেমেয়েরাও এখন অশিক্ষিত হচ্ছে। শিক্ষিত করতে হলে তো টাকা দরকার। সেই টাকা এখন শীতলপাটি বুনে ওঠে না।
বিজ্ঞাপন
চন্দন পাটিকরের স্ত্রী পুষ্প রাণী বলেন, প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৫টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত আবার দুপুরের খাবার শেষে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করে ৮ দিনে একটি পাটি বুনে শেষ করা যায়।
আয়-ব্যয়
প্রতিবেশী আরতী মন্ডল বলেন, একটি পাটি বুনতে ৮০টি পাইত্রাগাছ লাগে। ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় ৮০টি পাইত্রা কিনতে হয়। বর্ষার মৌসুমে শীতলপাটির চাহিদা কমে যায়। এ সময় খুচরা ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি করতে পারেন। তবে গরমের সময়ে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব। এ জন্য বর্ষা এলে কর্জ করতে হয়। আবার গরমকালে সেই কর্জ পরিশোধ করে দায়সারা ভালো আছে পরিবার।
একই পরিবারের পাটি ফেরিওয়ালা বিমল চন্দ্র মন্ডল বলেন, আমাদের তৈরি শীতলপাটি আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু প্লাস্টিক পাটির কারণে বাজারে চাহিদা কমে গেছে। সরকার যদি বিদেশে শীতলপাটি রফতানির কোনো ব্যবস্থা করত, তাহলে পাটিকরদের জীবন-জীবিকা ভালো থাকত। দেশেরও আয় হতো।
পাটিকর ভবতোষ চন্দ্র দত্ত বলেন, শীতলপাটি টিকিয়ে রাখতে হলে ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া উচিত। ঋণ নিয়ে আমরা শীতল পাটি তৈরি ও বিক্রি করে সেই টাকা পরিশোধ করতাম। নয়তো এই পেশায় টিকে থাকা দুঃসাধ্য। শিমুল রানী পাটিকর বলেন, শীতলপাটি বুনে একসময় আমাদের সংসার ভালো চলত। কিন্তু এখন আর সেই উপায় নেই। তার ওপর করোনার আঘাতে নিঃস্ব হয়ে গেছি।
স্বরূপ চন্দ্র দাস পাটিশিল্প ধ্বংস হওয়ার কারণ জানিয়ে বলেন, করোনার কারণে টানা দুই বছর দেশের বিভিন্ন স্থানের মেলা ও মাহফিল বন্ধ, তাই পাটি বিক্রি হয় না। সাধারণত মেলা ও মাহফিলে লাখ লাখ টাকার শীতলপাটি বিক্রি হয়। পাটিকররা সব সময় অপেক্ষা করেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মেলা-মাহফিলের। সেগুলো বন্ধ থাকায় পাটি বুনলেও এখন কেউ কিনছে না।
তিনি আরও বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ কৃষক ও দরিদ্র। তারা শীতলপাটি কম কেনেন। কিন্তু উত্তরাঞ্চলের মানুষ তুলনামূলক বিত্তবান হওয়ায় তারা শীতলপাটি বেশি ব্যবহার করেন। করোনায় উত্তরাঞ্চলে যেতে পারি না। এ জন্য দক্ষিণাঞ্চলে কম দামের প্লাস্টিকের পাটি ফেরি করে বিক্রি করে সংসার চালাই। আসলে পাটিকরদের করার কিছুই নেই; আমরা বেকার।
স্বরূপ চন্দ্র বলেন, একটি পাটি তৈরি করতে যে খরচ হয়, তা বিক্রি করে মূলধনই ওঠে না। এ জন্য অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছেন। আগে পাটিকর গ্রামে মহাজন এসে অগ্রিম টাকা নিয়ে বসে থাকতেন। এখান থেকে পাটি নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি বিদেশে রফতানি করতেন। আর প্লাস্টিকের পাটি এসে যাওয়ায় এখন এক বছরেও একজন মহাজন আসেন না।
পেশা বদলেছেন যারা
পাটিকর গ্রামের অনেকইে পেশা বদল করে ঝুঁকে পড়ছেন প্লাস্টিক পাটিশিল্পে। এর কারণ জানালেন সঞ্জয় পাটিকর। তিনি বলেন, আগের তুলনায় শীতলপাটির চাহিদা কম। আবার দাম বেশি হওয়ায় মানুষ কিনতে চায় না। এদিকে কম দামে প্লাস্টিকের পাটি কিনছে মানুষ বেশি।
যদিও শীতল পাটি স্বাস্থ্যসম্মত, পরিবেশবান্ধব, তারপরও প্লাস্টিকের পাটির প্রতি কেন মানুষের এত আগ্রহ, জানতে চাইলে পেশাচ্যুত সঞ্জয় বলেন, কম দামে চকচকা জিনিস পাওয়া যায়। মানুষ তো এখন ভালো-মন্দ বিচার করে না। চকচকা জিনিস বেশি দিন টেকে, সেটাও একটা কারণ।
পেশা বদলকারী সন্তোষ কুমার দত্ত বলেন, আগে আমরা শীতলপাটির কাজ করতাম। তখন পরিশ্রমের ন্যায্যমূল্য পেতাম। কিন্তু এখন শীতলপাটি বিক্রি করে সংসারই চালাতে পারি না। তিনি জানান, শীতলপাটি তৈরির কাজ ছেড়ে দুই বছর হলো প্লাস্টিক পাটি, প্লাস্টিকের পাটি কেটে হাতপাখা বিক্রি করে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ফেরি করে বিক্রি করছেন তিনি।
বাকেরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাধবী রায় বলেন, করোনাকালে উৎপাদনমুখী সব প্রতিষ্ঠানের কাজে আমরা কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি করছি না। বরং তাদের কাঁচামাল পরিবহন, শ্রমিক পরিবহনে সহায়তা করছি। এমনকি কুটিরশিল্পের বেলায়ও আমাদের একই অবস্থান। পাশাপাশি প্রতি ইউনিয়নে ৪ লাখ নগদ টাকা, ২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
আপনি যে রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের কথা বললেন, সেখানে ৬ হাজারের মতো মানুষের নামে ভিজিএফ কার্ড রয়েছে। অর্থাৎ সরকারি সহায়তা কোনো না কোনোভাবে সবার কাছে পৌঁছে দিচ্ছি আমরা। পাটিকরদের কুটিরশিল্প রক্ষায় আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা তাদের সহায়তা করব, বলেন এই কর্মকর্তা।
এনএ