জোড়পুকুরিয়া গ্রামে করোনায় মৃতদের কবর

কখন মসজিদের মাইকে কারো মৃত্যুর খবর আসবে, অথবা বাজবে অ্যাম্বুলেন্সের করুণ সুর, সে প্রতীক্ষায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার গাড়াডোব ও জোরপুকুরিয়া গ্রামের গোরখোদকরা।

রাত যত গভীর কিংবা আবহাওয়া যতই প্রতিকূল হোক না কেন, সব উপেক্ষা করেই মরদেহ দাফন করতেই হবে। এমনটি জানালেন জোড়পুকুরিয়া গ্রামের গোরখোদক হাবিবুর রহমান।

জানা গেছে, গত এক মাসে এ গ্রামে ২৬ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে ২৪ জনই মারা গেছেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। বাকি দুজন মারা গেছেন বার্ধক্যজনিত কারণে। একই অবস্থা গাড়াডোব গ্রামেও। সেখানে গত এক মাসে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ১০ জন করোনায় মারা গেছেন। বাকিরা উপসর্গ নিয়ে। সে গ্রামেও গোরখোদকরা পালাক্রমে রাত জেগে কবরস্থানের পাশে অবস্থান করেন। 

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে জোড়পুকুরিয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ বলেন, অল্প সময়ে এত মানুষের মৃত্যুর ঘটনা এবারই প্রথম। সবার মধ্যে মৃত্যু আতঙ্ক। কোথাও মাইকের শব্দ শুনলেই চমকে উঠছে মন।

একই গ্রামের গ্রাম্য চিকিৎসক ও গোরখোদক লিটন হোসেন বলেন, প্রতিদিন আমার কাছে চিকিৎসার জন্য আসা লোকজনকে করোনা পরীক্ষার জন্য জোর তাগিদ দিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না। জোড়পুকুরিয়া ও আশেপাশের গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের কারো না কারো করোনা উপসর্গ আছে। পরীক্ষা করলে শতকরা ৮০ জনের করোনা পজিটিভ পাওয়া যাবে। 

তিনি বলেন, এমনিতেই কেউ কবর খনন করতে চান না, এর ওপর আবার করোনাভাইরাস। অনেকেই ভয়ে মরদেহ দাফনে আসতে চান না। সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে আমরা গোর খননের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি। আমার গ্রামে ৩২ জন অভিজ্ঞ লোক রয়েছেন। তারা পালাক্রমে রাত জেগে মরদেহের জন্য অপেক্ষা করেন। কবর খনন ও দাফনের জন্য তাদের কোনো পারিশ্রমিক দিতে হয় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাইকে করোনা পরীক্ষা করে চিকিৎসা নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।

গাড়াডোব গ্রামে করোনায় মৃতদের কবর

গাড়াডোব গ্রামের বাসিন্দা আবু সুফিয়ান বলেন, আমি জুলাই মাসের ৭ তারিখ করোনায় আক্রান্ত হই। করোনা পজিটিভ হওয়ার পর বাড়িতে চিকিৎসা নিই। ২২ জুলাইয়ের পরীক্ষায় করোনা নেগেটিভ আসার পর থেকে দোকান খুলছি। সুফিয়ানের দোকানে পণ্য কিনতে এসেছেন গৃহিণী পানছুরা খাতুন। তিনি বলেন, আমি ২০ দিন ধরে সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত। আমার ছেলে সাইদ হোসেনেরও জ্বর। জ্বর নিয়েই ছেলে পাট কাটতে গেছে। করোনা পরীক্ষা করিয়েছেন কি না- জানতে চাইলে পানছুরা বলেন, করোনা পরীক্ষা করে কি গ্রামে এক ঘরে হব? পল্লী ডাক্তারের কাছ থেকে কয়েক ধরনের ওষুধ খেয়ে কিছুটা সুস্থ হয়েছি। 

একই গ্রামের গোর খোদক ভাদু মিয়া, আবুল হাসেন ও নাজির হোসেন জানান, প্রায় ২০ বছর ধরে তারা কবর খননের দায়িত্ব পালন করছেন। এক মাসে ২১টি কবর খনন করতে হয়েছে। এখন অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শুনলেই তারা আঁতকে ওঠেন। মনে হয়, ওই বুঝি এল লাশের গাড়ি। করোনা আতঙ্ক নিয়েও পালন করছেন সামাজিক এ অবৈতনিক দায়িত্ব। ইহকালের রোজগার নয়, পরকালে সৃষ্টিকর্তা যেন ক্ষমা করেন, ধর্মীয় এ অনুভূতি নিয়েই তারা দায়িত্ব পালন করছেন।

ধানখোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আখেরুজ্জামান বলেন, গাড়াডোব গ্রামে যারা মারা গেছেন, স্থানীয় গোরখোদকরাই তাদের দাফন করেছেন। তাদের কোনো স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রী কিংবা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয় না। করোনাকালে তারা মারাত্মক ঝুঁকিতে আছেন। তাদেরও করোনা পরীক্ষা করা দরকার। আমাদের পরিষদ থেকে তাদের জন্য কিছু করার সুযোগ নেই। তবে তারা যে দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের জন্য কিছু করতে পারলে ভালো লাগতো। তাদের এ মানবিক কর্মকাণ্ডে আমরা কৃতজ্ঞ। 

মেহেরপুর সিভিল সার্জন ডা. নাসির উদ্দীন বলেন, ঠান্ডা-কাশি যাদের হচ্ছে, তারা সচেতন হলে সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাদের হাসপাতালে আসতে হবে। প্রয়োজনে তাদের পরীক্ষা করতে হবে। পরীক্ষায় যদি কেউ পজিটিভ হন, তবে সু-চিকিৎসা দিয়ে তাকে সুস্থ করা সম্ভব। কিন্তু গোপন করলে, তিনি যেমনি শারীরিকভাবে ক্ষতির শিকার হবেন, তেমনি তার মাধ্যমে অন্যরাও সংক্রমিত হবেন। তাই ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে পরীক্ষা করতে এবং চিকিৎসা নিতে হবে। 

আকতারুজ্জামান/আরএইচ