বাঁশির সুর শুনে মৌমাছিরা এসে মাহতাব মোড়লের শরীরে বসে। দু-একটি নয়, ঝাঁক বেঁধে মৌমাছি ছেয়ে ফেলে তাকে। তার এই দৃশ্য দেখতে উৎসুক মানুষের ভিড় জমত। তবে এমনটি করতে কোনো কৌশলের আশ্রয় নেন না, এমনটা আগে জানালেও এখন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে এই কৌশলের বিষয়টিও মাহতাব নিজেই স্বীকার করে নিয়েছেন।

মাহতাব জানান, এটি করতে ভিন্ন এক কৌশলের আশ্রয় নিতে হতো তাকে। এটি করার আগে অগোচরে নিজের শরীরটাকে প্রস্তুত করে নিতেন মাহতাব। খুব ঘ্রাণ ছড়ায়, এমন কিছু শরীরজুড়ে মেখে নিতেন। ফলে সুবাস পেয়ে সহজেই আকৃষ্ট হয়ে তার শরীরে এসে বসত মৌমাছিরা।

মাসখানেক আগের ঘটনা। বাঁশি বাজালে এক মৌয়ালের শরীরজুড়ে মৌমাছি বসছে। এমন দৃশ্য ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ভাইরাল হলে চমক সৃষ্টি হয়। লোকমুখেও ঘটনাটি বিপুল মাত্রার প্রচার পায়। ফলে বিষয়টি উঠে আসে গণমাধ্যমেও। বাঁশির সুর তুললে মৌওয়াল মাহতাবের শরীরজুড়ে মৌমাছি বসে। এটি নিয়ে অনলাইন, প্রিন্ট, ইলেকট্রনিকসহ বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে সংবাদও হয়। তারপর রাতারাতি পরিচিত হয়ে ওঠেন মাহতাব।

গত ২১ জুন অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্টে ’বাঁশিতে ফুঁ দিতেই শরীরে বসে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি’ শিরোনামে বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যদিও তখন মাহতাব দাবি করেছিলেন, ‘বাড়ির পাশেই একটি মৌমাছির মৌচাক রয়েছে। বাঁশি বাজালে সুর শুনে হাজারো মৌমাছি এসে বসে। মৌমাছি বসতে বসতে শরীর তার মৌচাকের আকার ধারণ করে। কৌশলগত ওই সুর শুনে হাজারো মৌমাছি তার শরীরে জড়ো হয়। বাঁশি বাজানো বন্ধ করলে মৌমাছি চলে যায়।’

বাঁশি বাজিয়ে মৌমাছিকে আকর্ষিত করে শরীরে টেনে আনার দৃশ্য দেখতে তার বাড়িতে উৎসুক মানুষের ভিড় জমে। আর এটি নিয়ে চলতে থাকে নানামুখী আলোচনাও। তবে জীববৈচিত্র্যের ব্যাপারে অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞরা বাঁশির সুরে মৌমাছি আকৃষ্ট হয়, প্রথম থেকেই তারা এটি মানতে নারাজ ছিলেন। এ ক্ষেত্রে তাদের অনেকের মত ছিল, হয়তো কোনো ধরনের হরমোন কিংবা ফেরোমন জাতীয় কোনো ‘টোপ’ ব্যবহার করে এমনটি করা হচ্ছে। আর পরবর্তীতে তাদের ধারণার খানিকটা মিলেও গেছে। অনুসন্ধানের পর ঢাকা পোস্টের কাছে মাহতাব মৌয়াল তা জানিয়েছেন।

আগের প্রকাশিত প্রতিবেদনে ঢাকা পোস্ট দ্বারস্থ হয় বিষেশজ্ঞ মতামতের। তখন যশোর সরকারি মহিলা কলেজের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নার্গিস শিরীন জানিয়েছিলেন, মৌমাছিরা মধুর ওপর আকৃষ্ট হয়। তাই কেউ যদি তার শরীরে মধু, হরমোনযুক্ত সুগন্ধি স্প্রে করে, তখন উড়ে এসে মৌমাছিরা বসতে পারে।

জানা গেছে, মাহতাবের গায়ে মৌমাছি বসার ঘটনা নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। প্রাণিবিদ্যা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিরাও এটি নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করতেন। আবার তারা এমনও বলেছেন, যেহেতু বিজ্ঞানের আলোকে এটির কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া যাচ্ছে না, তাই এটি অলৌকিকও হতে পারে। স্থানীয় অনেক মানুষ এটিকে মাহতাবের এটি ছিল সাজানো নাটকও বলেছেন।

প্রথম দিকে মাহতাব দাবি করেন, মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহের সময় মৌমাছির প্রতি তার ভালোবাসা জন্মায়। তার বাড়ির পাশেই একটি মৌচাক রয়েছে। বাঁশিতে সুর তুললে মৌমাছি শরীরজুড়ে বসে। মৌমাছি বসতে বসতে শরীর তার মৌচাকের আকার ধারণ করে। সুর শুনেই মৌমাছি তার শরীরে জড়ো হয়। বাঁশি বাজানো বন্ধ করলে মৌমাছি চলে যায়। এতে কোনো ‘অসৎ উপায় ও তন্ত্র-মন্ত্র’ নেই। বাড়িতে বাঁশি বাজিয়ে পাঁচ মিনিটেই তিনি শরীরে হাজারো মৌমাছি জড়ো করতে পারেন। কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ হলেও অভ্যাস হয়ে যাওয়ায় কোনো ভয় লাগে না।

মাহতাবের গ্রামের সেলিম হোসেন নামের একজন বলেন, ছোটকাল থেকেই মাহতাব বনজঙ্গলে মধু সংগ্রহ করে বেড়ান। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে, বাঁশি বাজালে তার শরীরে মৌমাছি এসে বসছে। আগে কোনো দিন এমন দৃশ্য দেখেনি বা শুনিনি। তবে মাহতাব ভাই বাঁশি বাজিয়ে মৌমাছি নিয়ে আসার আগে শরীরে আঠালো কিছু একটা মেখে নেন। তার শরীরে ঘাম ঘাম ভাব থাকে। এর মধ্যে অন্য কোনো রহস্য আছে কি না, সেটি তার জানা নেই।

যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের (এম এম কলেজ) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রধান মহাসিন উদ্দিন বলেন, মাহতাবের বিষয়টা অলৌকিক ঘটনা বলে মনে হয়েছে। তার ভাষ্যমতে, মৌমাছির সামাজিক আচরণ চমকপ্রদ। এমনটি প্রাণিবিজ্ঞানে বলা আছে। কিন্তু বাঁশির সুর মৌমাছিকে আকৃষ্ট করে, এমনটি বলা নেই। তিনি আরও জানান, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের যেসব রেফারেন্স বই আছে, সেখানেও মৌমাছির আচরণে এ রকম বিষয় বলা নেই। তবে ফেরোমনে মৌমাছি আকৃষ্ট হয়। তাই মাহাতাব ফেরোমন-জাতীয় কিছু ব্যবহার করছেন কি না, সেটা নিয়ে তিনি সন্দিহান।

যশোর সরকারি মহিলা কলেজের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নার্গিস শিরীন বলেন, মৌমাছিরা নিজস্ব ভাষা দিয়ে একে ওপরের সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু বাঁশির সুরের প্রতি মৌমাছির আকৃষ্ট হওয়ার সুযোগ জানা নেই। বইপুস্তকেও আমরা তা পাইনি। মৌমাছিরা মধুর ওপর আকৃষ্ট হয়। কেউ যদি তার শরীরে মধু, হরমোনযুক্ত স্মেল স্প্রে করে, তখন এসে বসতে পারে। এ ছাড়া আর কোনো সুযোগ নেই বলে জানান তিনি।

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে বাঁশি বাজিয়ে মৌমাছি আনার আসল রহস্য স্বীকার করে মাহতাব বলেন, ‘পোকা তো ফুলের ঘ্রাণের পাগল। তাই বাঁশির সুরে পোকা আসবে না ও শরীরে বসবেও না। বাঁশি বাজানোর আগে শরীরটা প্রস্তুত করে নিই। আমার শরীরে যখন ঘাম থাকে না, তখন মিষ্টি কুমড়ার ফুল বা যে ফুলে মৌমাছি আকৃষ্ট হয় (সুগন্ধি ফুল) সারা শরীরে লাগিয়ে নিই। এতে সারা শরীরে একটা ঘ্রাণ চলে আসে। আর ঘ্রাণ পেলে পোকা চলে আসে।

তিনি আরও বলেন, পোকা এলে ওদের খেতে দিতে হয়। খাওয়া শেষ হয়ে গেলে আমি রৌদে দাঁড়িয়ে বা দৌড়ে সারা শরীরে ঘাম ঝরিয়ে নিই। এরপর বাঁশি বাজালে মৌমাছি এসে ঘাম খাওয়া শুরু করে। খারাপ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আমি এই কাজ করি না।

কেশবপুর উপজেলার হাসানপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান প্রভাষক জুলমত আলী বলেন, দীর্ঘদিন মাহাতাব মধু সংগ্রহ করে বেড়ান। সম্প্রতি শুনেছি বাঁশির সুরে মৌমাছি তার শরীরে আসে। বিভিন্ন স্থান থেকে তার বাড়িতে মানুষ এই দৃশ্য দেখতে আসছে। তবে আমি কখনো সরাসরি দেখিনি।

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী সায়েমুজ্জামান বলেন, গণ্যমাধ্যমে দেখেছি যশোরের কেশবপুরে মৌমাছি মাহতাব বাঁশি বাজিয়ে তার কাছে মৌমাছি নিয়ে আসছে। এটা নিয়েও যশোরসহ দেশব্যাপী সাড়া পড়েছে। তবে কৃষি বিভাগের বিশেষজ্ঞরা এটার বিষয়ে খোঁজখবর নেবেন।

এনএ