ঝগড়া-বিবাদের এক পর্যায়ে আয়নাল হক ও তার স্ত্রী জমিরন বেগম দম্পতি একে অপরকে তিন তালাক দিয়েছিলেন। পরে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অন্য কাজি অফিসে (নিকাহ রেজিস্ট্রার) গিয়ে আবার বিয়ে করে সংসার করছেন তারা। কিন্তু বাদ সাধে অন্যখানে। সমাজপতিরা তাদের এ বিয়ে মেনে না নিয়ে উল্টো ফতোয়া জারি করে তাদের একঘরে করে রেখেছেন।

দুজনকে কথা বলতে না দেওয়া, তাদের বাড়িতে কাউকে যেতে না দেওয়া; নিজের ভাই, ছেলে, আত্মীয়স্বজনসহ কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে না দেওয়ার শর্ত আরোপ করা হয়েছে। ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক হিল্লা বিয়ে দিয়ে এরপর সংসার করতে হবে আয়নাল-জমিরন দম্পতিকে, এমন সিদ্ধান্তও চাপিয়ে দিয়েছেন সমাজপতিরা।

চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি ঘটে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার সুন্দরদিঘী ইউনিয়নের ছলিমনগর গ্রামে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভুক্তভোগী জমিরন নেছা ৯ আগস্ট দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রত্যয় হাসানের বরাবর ১০ সমাজপতির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগে জানা গেছে, আয়নাল হক ও জমিরন বেগম প্রায় ৩০ বছর ধরে সংসার করে আসছেন। তাদের সংসারে ৪ সন্তানসহ নাতি-পুতিও আছে। দরিদ্র এই পরিবারে দুই-তিন মাস আগে হঠাৎ স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হয়। পরে রাগের এক পর্যায়ে তারা একে অপরকে তিন তালাক দেন। বিষয়টি জানাজানি হলে ছলিমনগর জামে মসজিদের সভাপতি নাছির উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল ইসলাম, শাহজান আলী, ইমান আলী, হাফেজ মোস্তফা কামাল, জুলহাস, সুরমান মেম্বার, আমির চাঁদ, আব্দুর রশিদ, দেলোয়ার হোসেনসহ স্থানীয় বেশ কয়েকজন সমাজপতি বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করেন।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পাশের এলাকার মাওনালা মুফতি আনোয়ার হোসাইন ও হাফেজ মোস্তফা কামাল নামের দুজন আলেম। তারা জমিরন বেগমকে হিল্লা বিয়ে দেওয়ার পর আবার বিয়ে করে সংসার করার ফতোয়া দেন এবং আয়নাল ও জমিরন একসঙ্গে সংসার ও বসবাস করতে পারবেন না বলে জানান। এই নিয়ম না মানলে সমাজচ্যুত করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে।

এদিকে আয়নাল ও জমিরন ভুল-বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে সমাজপতিদের সিদ্ধান্ত না মেনে দিনাজপুর খানসামা উপজেলায় জনৈক মাওলানার বাড়িতে গিয়ে আবার বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। এতে সমাজপতিরা ক্ষুব্ধ হয়ে  তাদের সঙ্গে কথা বলা, বাড়িতে যাতায়াত, কোনো জিনিসপত্র আদান-প্রদান, হাটবাজারসহ সবকিছুতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন।

বর্তমানে গ্রামের কোনো দোকান তাদের কাছে পণ্য বিক্রি করছেন না। তাদের কোথাও কোনো কাজে নেওয়া হচ্ছে না। সমাজপতিরা তাদের পরিবারের অন্য সদস্য ও আত্মীয়স্বজনকেও নিষেধ করে দিয়েছে তাদের বাড়িতে যেতে। কেউ যোগাযোগ করলে তাকেও একঘরে করা ও ৫০০ টাকা জরিমানার আদেশ জারি করা হয়েছে। এতে দুই মাস ধরে এই দম্পতি একঘরে অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

এ বিষয়ে সুন্দরদিঘী ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য লক্ষ্মণ চন্দ্র রায় জানান, আয়নাল ও জমিরন নেছা ঝগড়া করে একে অপরকে তালাক দিয়েছিল বলে আমি শুনেছি। তাদের একঘরে (বয়কট) করে রাখা হয়েছে। আমি স্থানীয় সমাজপতিদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বসেছিলাম কিন্তু ইসলামি আইন-কানুনের কথা বলে তারা হিল্লা বিয়ে দিতে সম্মত হয়। আমার কথা তারা না শোনায় আমি এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারিনি।

ছলিমনগর জামে মসজিদের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মোমিনুর ইসলাম জানান, স্থানীয় সমাজের বৈঠকে লোকজনের উপস্থিতিতে মুফতি আনোয়ার হোসাইন ও হাফেজ মোস্তফা কামাল আয়নাল ও জমিরনকে সমাজ থেকে বয়কট করেন। সমাজের লোকজনের সঙ্গে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ফতোয়া দেন।

আয়নাল হক ও জমিরন বেগমের বড় ছেলে ওমর ফারুক বলেন, আমার মা-বাবার তালাকের বিষয়টি নিয়ে সমাজপতিরা তাদের আলাদা করে দিয়েছে। আমাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে দেয় না। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে আমাদেরও একঘরে করে রাখা এবং ৫০০ টাকা জরিমানা করা হবে বলে সিদ্ধান্ত দেন। কিন্তু আমার মা-বাবা তাদের নিজেদের ভুল বুঝতে পেয়ে তারা মাওলানার কাছে গিয়ে আবার বিয়ে করেন। তারপরও সমাজপতিরা আমাদের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। তারা আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধা দিচ্ছে।

লিখিত অভিযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করে দেবীগঞ্জ ইউএনও মো. প্রত্যয় হাসান জানান, স্থানীয়ভাবে উভয় পক্ষের সঙ্গে বসে মীমাংসার জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যানকে বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১২ আগস্ট) সকালে বিষয়টি নিয়ে ছলিমনগর গ্রামে বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। আমি নিজেও সেখানে উপস্থিত থাকব।

মো. রনি মিয়াজী/এনএ