পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে বেকার ছিলেন আরিফুল ইসলাম। নিজে থেকে কিছু করার ইচ্ছে থাকলেও তার ছিল না কোনো পরিকল্পনা। এ কারণে কিছুটা হতাশায় ভুগছিলেন ৩২ বছর বয়সী এ তরুণ। তবে ছোট ভাইয়ের পরামর্শ আর শখের বসে শুরু করেন পাখি পালন। শুরুতে শখের খাঁচায় পাখি ছিল মাত্র তিন জোড়া। ৬ মাস পর নতুন করে যোগ হয় আরও দুই জোড়া। এরপরই শুরু হয় ডিম দেওয়া। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পাখির জোড়া দাঁড়ায় ত্রিশে। বেকারত্ব ঘুঁচে আরিফুলকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

বিদেশি পাখি পালন করে সফলতার গল্প খুঁজে পেয়েছেন আরিফুল। এখন বাণিজ্যিকভাবে পাখি পালন ও বিক্রি করছেন এই তরুণ। কয়েক বছরের মধ্যে গ্রামের মানুষের মাঝে সাড়াও ফেলেছেন। বর্তমানে প্রতি মাসে পাখি বিক্রি করে তার আয় হচ্ছে ২৫-৩০ হাজার টাকা। তবে অতিমারী করোনাকালে পাখি সংগ্রহ স্বাভাবিক থাকলে মাসিক আয় ৫০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যেত বলে মনে করেন আরিফুল।

রংপুর জেলার তারাগঞ্জের সয়ার ইউনিয়নের মন্ডলপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম। চার বছর ধরে নিজের গ্রামের বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন পাখির খামার। শখের বসে খাঁচায় পাখি পালন শুরু হলেও এখন আরিফুল পুরোদমই বাণিজ্যিক। প্রতিদিন তার খামারে পাখি দেখতে ও কিনতে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসেন। বাণিজ্যিকভাবে পাখি পালন করে নিজে সফল হওয়ায় অন্যদেরও স্বপ্ন দেখাচ্ছেন আরিফুল।

সম্প্রতি তারাগঞ্জে পাখির ওই খামারে ঘুরতে গিয়েছিলেন ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক। সেখানে বেকারত্বের অভিশাপ ঘুঁচে সফল হয়ে ওঠার গল্প শোনান আরিফুল ইসলাম। সময়ের সঙ্গে লক্ষ্য স্থির রেখে মন থেকে চেষ্টা করলে দেরিতে হলেও সুফল আসে বলে বিশ্বাস তরুণ এই উদ্যোক্তার।

আরিফুল ঢাকা পোস্টকে জানান, তার খামারে বর্তমানে বাজরিকা, ফিঞ্চ, মুনিয়া, ডায়মন্ড ডোভ জাতের ৫০-৬০ জোড়া পাখি রয়েছে। এসব পাখির অনবরত কিচিরমিচির শব্দে চারপাশ মুখরিত থাকে। সঠিক পরিচর্চা ও রক্ষণাবেক্ষণে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর পর তা বড় করা হয়। এরপর বয়স অনুযায়ী বিভিন্ন দামে বিক্রি করা হয়।

তার খামারে বাজরিকা পাখির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই পাখি প্রাথমিক অবস্থায় ৪-৫টি ডিম দেয়। পরে সংখ্যা বেড়ে ১০-১২টি পর্যন্ত ডিম দিয়ে থাকে। ডিম থেকে বাচ্চা হতে ১৭-১৮ দিন সময় লাগে। বাচ্চাগুলো উড়তে সক্ষম হয় ৩০-৩৫ দিন বয়সে। প্রজনন উপযোগী হতে সময় লাগে ৪ মাস। তবে ৪-৮ মাস বয়সে প্রজনন ক্ষমতা অনেক বেশি হয়। অন্যান্য জাতের পাখিগুলোও কাছাকাছি সময় নেয়।

বাজরিকা পাইকারি ৮০০ টাকা, খুচরা ১২০০-১৬০০ টাকা জোড়া বিক্রি করছেন। ফিঞ্চ পাইকারি ৬০০ টাকা ও খুচরা ৭০০-৮০০ টাকা জোড়া। মুনিয়া জোড়া ৪০০-৪৫০ টাকা পাইকারি ও খুচরা বিক্রি ৫০০-৬০০ টাকা। ডায়মন্ড ডোভ জোড়া প্রতি পাইকারি ১৫০০-১৬০০ ও খুচরা ২০০০-২২০০ টাকা বিক্রি করছেন।

এসব পাখিকে খাবার হিসেবে চিকন ধান, কাউন, চিনা ও সূর্যমুখী ফুলের বীজ দেওয়া হয়। প্রতি মাসে একেক জোড়া পাখির জন্য তার ৭০-৮০ টাকা খরচ হয়। বর্তমানে খরচ বাদে আরিফুল মাসে ২৫-৩০ হাজার টাকা আয় করছেন। তবে করোনা মহামারির কারণে ঠিক মতো পাখি সংগ্রহ করতে পারছেন না জানিয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে স্বাভাবিক সময়ে তার ব্যবসা ভালো ছিল। মাসে চল্লিশ হাজারের কাছাকাছি আয় হতো। কিন্তু করোনাকালে পাখি বিক্রি কমে এসেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে মাসে ৫০ হাজার টাকার বেশি আয় করা সম্ভব।  

কিভাবে পাখি পালন শুরু করলেন, জানতে চাইলে আরিফুল সেই গল্প শোনান। তার ভাষ্য মতে, লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে ছোট ভাই হাফেজ আসিফের পরামর্শে মাত্র তিন জোড়া পাখি দিয়ে শুরু করি। ছয় মাস পর নতুন করে আরও দুই জোড়া পাখি আনি। এরপর তিন জোড়া পাখি ডিম দিয়েছিল ৬-৭টি করে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ৩০ জোড়া পাখির পরিবার হয়ে যায়। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

এ ব্যাপারে ভেটেরিনারি ফিল্ড এসিস্ট্যান্ট ফিরোজ মিয়া বলেন, ব্রিডিং উপযোগী খাঁচার দাম সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা। একজোড়া পাখি দিয়ে সফলতা আসার সম্ভাবনা কম। তাই প্রথমে কমপক্ষে দুই জোড়া পাখি দিয়ে শুরু করলে ভালো হয়। দুই জোড়া পাখির বয়স তিন থেকে চার মাসের মধ্যে হলে ভালো হয়।

তিনি জানান, প্রথমে একটি খাঁচার মধ্যে শুধু পুরুষ পাখি রাখতে হবে। তাকে কমপক্ষে ছয় থেকে সাত মাস বয়স পর্যন্ত রাখতে হবে। একইভাবে আরেকটি খাঁচায় স্ত্রী পাখি রাখতে হবে। এবার দুই খাঁচা এক করে দিতে হবে। খাঁচায় দেওয়ার এক থেকে দুই মাসের মধ্যে হাঁড়ি ঝোলাতে হবে খাঁচার এক কোণে। পাখি বসার স্থান থেকে দূরে একটি পানির পাত্র রাখতে হবে। খাবারের পাত্র হাঁড়ির নিচে থাকলে ভালো। খেয়াল রাখতে হবে, পাত্রগুলো যেন পাখির মল থেকে নিরাপদ থাকে। বাসা পাল্টালে বা পাখির স্থান পরিবর্তন করলে পাখি প্রজননে বাধা আসবে। তাই পাখি পালনে ধৈর্য ধারণ করতে হয়।

এদিকে পশু-পাখি পালনে উদ্যোক্তাদের সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার কথা জানালেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. একেএম ফরহাদ নোমান। ঢাকা পোস্টকে তিনি জানান, বাণিজ্যিকভাবে পাখি পালন করার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। অল্প পুঁজি ও স্বল্প জায়গাতেই পালন করা যায়। আরিফুলের মতো অনেক বেকার যুবক বাড়িতে কবুতর ও পাখি পালন করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এসপি