চলতি পথে হোঁচট খেয়ে পড়ে যান বালুর স্তূপে। এতে পুরো শরীরে বালু লেগে যায়। তাৎক্ষণিক চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুই চোখই বালু থেকে সুরক্ষিত থাকে। এর থেকে মাথায় উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশ ঘটে। সেই চিন্তা থেকেই কলেজছাত্র অপূর্ব মজুমদার তৈরি করেন করোনাভাইরাস প্রতিরোধমূলক সুরক্ষা ডিভাইস।

ডিভাইসটির উদ্ভাবক অপূর্ব মজুমদার লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষার্থী। তার বাবা নিখিল মজুমদার রামগঞ্জ উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা। তারা দুই ভাই। থাকেন লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সমসেরাবাদ এলাকায়।

অপূর্ব তার ডিভাইসটির নাম দিয়েছেন ‘বঙ্গ সোশ্যাল ডিসটেন্স ব্রেকিং অ্যালার্ট কিট উইথ অ্যাডভান্স শার্টার টেকনোলজি।’ হেলমেটের সঙ্গে এ ডিভাইসটি সংযুক্ত করা হয়েছে। ডিভাইসটি পরিহিত ব্যক্তির ৩ ফুট দূরত্বে কোনো মানুষ আসলেই সেন্সরটি তা অনুধাবন করবে। সঙ্গে সঙ্গে হেলমেটের সঙ্গে লাগানো অত্যাধুনিক শিল্ডটি মুখমন্ডল ঢেকে দেবে। এতে ডিভাইসটি মাস্কের পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। একই সঙ্গে ডিভাইসটি আর্টিফিসিয়াল ভয়েস অ্যালার্টের মাধ্যমে সতর্ক বার্তা দেবে। 

সতর্ক বার্তাটি হল- ‘মাস্ক পরিধান করুন। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলুন। নিয়মিত ২০ সেকেন্ড পর্যন্ত হাত ধৌত করুন।’ ডিভাইসটি ব্যবহারকারীর সামনে কোনো ব্যক্তি যতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে ততক্ষণ সুরক্ষা দিতে পারবে। এছাড়া সামনের ব্যক্তি সরে যাওয়ার পর সর্বোচ্চ এক মিনিট পর্যন্ত শিল্ডটি মুখমন্ডল ঢেকে রাখবে। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সহায়তা পেলে ডিভাইসটি উন্নতমানের করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন অপূর্ব।

অপূর্বের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় সাত মাস আগে হাঁটতে বের হয়ে হঠাৎ করে হোঁচট খেয়ে তিনি বালুর স্তূপে পড়ে যান। এতে তার পুরো শরীরে বালু লেগে যায়। তাৎক্ষণিক চোখের দুটি পাতা বন্ধ হয়ে যায়। এতে চোখের ভেতর বালু ঢুকতে পারেনি। এর থেকেই তার মাথায় উদ্ভাবনী চিন্তা কাজ করে। তার ধারণা- যদি চোখের পাতা পড়ে গিয়ে কোনো বস্তু থেকে চোখকে রক্ষা করতে পারে, তাহলে এমন কিছু উদ্ভাবন করা যায় কিনা? যা মানুষকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করবে এবং করোনা প্রতিরোধে সহায়তা করবে।

সে লক্ষ্যে তিনি গবেষণা শুরু করেন। ১৫ বার গবেষণায় ব্যর্থ ও সাতবার যন্ত্রপাতি বদল করার পর ১৬তম চেষ্টায় তিনি সফল হয়েছেন। উদ্ভাবন করেছেন ‘বঙ্গ সোশ্যাল ডিসটেন্স ব্রেকিং অ্যালার্ট কিট উইথ অ্যাডভান্স শার্টার টেকনোলজি ডিভাইস।’ গবেষণার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার ১০ হাজার টাকারও বেশি খরচ হয়েছে। তবে এটি তৈরি ও মানুষের হাতে পৌঁছাতে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকার মতো খরচ পড়বে।

ডিভাইসটির সঙ্গে বিল্ট ইন ব্লুটুথ সুবিধা রয়েছে। যা সচেতনতা বৃদ্ধিমূলকসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যাবে। এতে লাগানো ওয়্যারলেস ভয়েস ট্রান্সমিশন সিস্টেমটি ডিভাইসটি ব্যবহারীকে মাস্ক পরিহিত অবস্থায় কথা বলতে সহায়তা করবে। উন্নতমানের লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি সংযুক্ত ডিভাইসটি এক চার্জে টানা তিনদিন ব্যবহার করা যাবে। সাধারণ মুঠোফোনের চার্জার কিংবা সোলার দিয়েও ডিভাইসটি চার্জ দেওয়া যাবে। এটি একটি পরিবেশবান্ধব ও সহজে হস্তান্তর যোগ্য ডিভাইস। রেডিও সুবিধাও রয়েছে। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে এটি তৈরি করা হয়েছে। ডিভাইস থেকে মোবাইল চার্জের সুবিধাও রয়েছে।

 ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিচার্সের (আইসিএমআর) এক গবেষণায় দেখা গেছে- সঠিকভাবে সামাজিক দূরত্ব না মেনে চললে একজনের থেকে ৪০৬ জন করোনা সংক্রমিত হতে পারেন। আর যদি দূরত্ববিধি ৭৫ শতাংশ মানা হয় সেক্ষেত্রে একজন রোগী থেকে মাত্র আড়াইজনের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। এজন্য করোনা বিস্তার রোধে পদক্ষেপ হিসেবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি। সে লক্ষ্যে অপূর্ব তার ডিভাইসটি তৈরি করেন। ডিভাইসটির তিন ফুট দূরত্বে থাকা ব্যক্তিকে বা ব্যক্তিবর্গকে আর্টিফিশিয়াল ভয়েস অ্যালার্টের মাধ্যমে সতর্ক বার্তা প্রদান করবে।

এ ব্যাপারে অপূর্ব মজুমদার  ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডিভাইসটি তৈরিতে প্রায় সাত মাস কাজ করতে হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ বার ব্যর্থ হয়েছি। সাত বার যন্ত্রপাতি বদলাতে হয়েছে। ১৬তম চেষ্টায় আমি সফল হয়েছি। আমার এ ডিভাইসটি জরুরি বিভাগ, মাঠপর্যায়ের কর্মী ও করোনা আক্রান্ত রোগীসহ সাধারণ জনগণ সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে ব্যবহার করতে পারবেন। আমার ডিভাইসের সেন্সরটি ৬০ ডিগ্রি কোণে সর্বোচ্চ ৪০ ইঞ্চি দূর পর্যন্ত কাজ করবে। চাইলে ডিভাইসটি কাস্টমাইজ করা যাবে।

তিনি আরও বলেন, মানুষ ছাড়া বিভিন্ন প্রাণী থেকেও করোনা ছড়াতে পারে। সেক্ষেত্রে অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও ডিভাইসের সেন্সরটি কাজ করবে। এ ডিভাইসটি খুব সহজেই মানুষ ব্যবহার করতে পারবে। উন্নত প্রযুক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই নিজের গবেষণা থেকেই তিনি ডিভাইসটি তৈরি করেছেন বলেও জানান। 

লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মো. ফিরোজ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অপূর্ব মেধাবী ছাত্র। তার মধ্যে উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রবল। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে আইসিটি বা বিজ্ঞান বিষয়ক মেলায় অপূর্ব সব সময় কলেজের মুখ উজ্জ্বল করেছে। তার তৈরি করা প্রজেক্টগুলো ইউনিক। উদ্ভাবনী চিন্তা-চেতনা নিয়ে সে কাজ করে। সমাজ ও পরিবেশের উপকারে আসে এমন চিন্তা নিয়ে কাজ করে।

তিনি আরও বলেন, অপূর্বের বর্তমান প্রজেক্টটা পুরোপুরি দেখেছি। তাকে কিছু পরামর্শও দিয়েছি। তার ডিভাইসটা শুধু ফ্রন্ট সাইজে কাজ করে। চারদিকে কাজ করে সেভাবে ডিভাইসকে তৈরি করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি সে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে। তবে অপূর্ব বলছে- শিক্ষার্থী হয়ে ডিভাইসটি তৈরিতে পর্যাপ্ত খরচ বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। সবার সহযোগিতা পেলে আরও ভালোভাবে সে প্রজেক্টটি তৈরি করতে পারবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার পাশে আছি। প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার জন্য বুধবার (১৮ আগস্ট) কলেজ অধ্যক্ষের সঙ্গে তার ব্যাপারে কথা বলব।

হাসান মাহমুদ শাকিল/আরএআর