‘চাকরির পেছনে কখনো ছুটিনি। পাখির মত স্বাধীনভাবে চলতে চেয়েছিলাম। স্কুলজীবন থেকেই পাখিই আমার সব। সব সময় স্বপ্ন দেখতাম পাখির ছোট একটি খামার করব। সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি। বাড়ির বারান্দা ও ছাদের কোণে ছোট একটি খামারও গড়ে তুলেছি। পাখির চাহিদাও রয়েছে।’ কথাগুলো বলছিলেন শরীয়তপুরের ডামুড্যা পৌরসভার বিল্লাল কাজির ছেলে ফজলে রাব্বি (২৫)।  

জানা গেছে, ফজলে রাব্বি জেড এইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগ থেকে ২০১৯ সালে বিবিএ সম্পন্ন করেছেন। তারা দুই ভাই এক বোন। বাড়িতে বিদেশি পাখি পালন করে সফল হয়েছেন তিনি। তার এই উদ্যোগে প্রথমে পরিবার পাশে না থাকলেও এখন সবাই তাকে বেশ উৎসাহিত করছে। এখন বাণিজ্যিকভাবে পাখি পালন ও বিক্রি করছেন রাব্বি। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে জেলার মানুষের মাঝে সাড়াও ফেলেছেন। নিজ বাড়ির বারান্দা ও ছাদে গড়ে তুলেছেন পাখির খামার। পাশাপাশি রয়েছে ছাদ বাগানও। 

শখের বসে খাঁচায় পাখি পালন শুরু হলেও এখন রাব্বি পুরোদমেই বাণিজ্যিকভাবে পাখি পালন করছেন। প্রতিদিন তার খামারে পাখি দেখতে ও কিনতে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসছে। বাণিজ্যিকভাবে পাখি পালন করে নিজে সফল হওয়ায় অন্যদেরও স্বপ্ন দেখাচ্ছেন রাব্বি। 

ফজলে রাব্বি বলেন, স্কুলে যাব, তখনই শর্ত কবুতর কিনে দিলে যাব। এর জন্য অনেক বকা খেতে হয়েছে পরিবারে কাছ থেকে। ২০০৬ সালে দাদার কাছ থেকে ৩৫ টাকা নিয়ে এক জোড়া কবুতর কিনি। সেই থেকে শুরু। এখন কয়েক লাখ টাকার পাখি রয়েছে আমার খামারে।

তিনি বলেন, এসএসসি পরীক্ষা শেষে ২০১১ সালে ঢাকায় একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে যাই।  সেখানে দেখি খাঁচায় পোষা হরেক রকমের পাখি। কিন্তু সাহস পাইনি কেনার। কয়েকদিন পর ঢাকা থেকে আসার সময় খাঁচায় করে দুটি পাখি নিয়ে আসি। মা ছাড়া সবাই এটির বিরোধিতা করেছে। কেন আনছি, কী করবো বিভিন্ন প্রশ্ন করে। এই বিষয়টা নিয়ে আমাকে এক সপ্তাহ চাপে থাকতে হয়েছে। 

সরেজমিনে রাব্বির খামার ঘুরে দেখা যায়, তার রুমের বারান্দায় সারিবদ্ধভাবে গ্রিলের সঙ্গে খাঁচা বাঁধা রয়েছে। তার মধ্যে বিদেশি হরেক রকমের রঙিন পাখি। পাখির কিচিরমিচির শব্দ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষের নজর কাড়ে। ভোর হলে আশপাশের লোকজনের ঘুম ভাঙে পাখির কিচিরমিচির শব্দে। ছাদে দেখা যায় দুটি পাখির ঘর। একটিতে বিদেশি বিভিন্ন জাতের কবুতর আর অন্যটিতে বিদেশি পাখি রয়েছে। 

ছাদজুড়ে করা হয়েছে বাগান। সেখানে বট, কৃষ্ণচূড়া, বাগান বিলাশ, খেজুর, পাকুরের গাছের বনশাইসহ বিভিন্ন প্রকার দেশি-বিদেশি গাছ রয়েছে। খাঁচায় রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার কাকাতুয়া, ফ্রিন্স, কোকাটেল, লাভ বার্ড, কুনুর, বাজরিগার, ঘুঘুসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। কাকাতুয়া রাব্বির কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়ায়। এছাড়াও তার কাছে রয়েছে বিদেশি জাতের কাদাকনাথ, সিলকি, ব্যানথাম মুরগি। 

বর্তমানে বাজারে লাভ বার্ড পাইকারি ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা, খুচরা ৪ থেকে ৮ হাজার টাকা, ফিন্সি পাইকারি ৪শ থেকে ৬শ আর খুচরা ৬ থেকে ১ হাজার টাকা, বাজরিগার পাইকারি ৪ থেকে ৭ শত খুচরা ৫ থেকে ১ হাজার, ঘুঘু পাইকারি ৮শ থেকে ১ হাজার ৪শ টাকা, খুচরা ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৬শ টাকা, কোকাটেল পাইকারি ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা, খুচরা সাড়ে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা, কুনুর পাইকারি ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা, খুচরা ৭ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা, জাভা পাইকারি ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা, খুচরা ২ হাজার ৩শ থেকে ৩ হাজার টাকা বিক্রি হয়। এছাড়া আরও ৮ প্রজাতির পাখি রয়েছে রাব্বির সংগ্রহে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে পাখিগুলো ডিম দেবে। 

ফজলে রাব্বি বলেন, ছাত্রজীবনে টিফিনের টাকা জমিয়ে এক জোড়া এক জোড়া করে পাখি কিনে আনি। ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে বাড়ির বারান্দায় জায়গা না হওয়ায় ছাদে ৬ ফুট বাই ৬ ফুট একটি ঘর করে পাখি পালন শুরু করি। সেটিও কিছুদিনের মধ্যে ভরে যায় পরে সেটিকে প্রসস্ত করি। এখন সব মিলিয়ে আগামী সিজনের জন্য ১০০ জোড়া পাখি প্রস্তুত রয়েছে। আমার স্বপ্ন আমার এই খামারে কয়েকজন বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হবে। 

তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন সকাল-বিকেল পাখিদের খাবার দেই। তাদের রুম প্রতিনিয়ত পরিষ্কার করি। যাতে করে কোনো ধরনের রোগবালাই না হয়। কয়েকদিন পর পর হাঁড়ি পরিবর্তন করে দেই। ফিন্সি পাখিকে মাঝে মধ্যে কাজে ব্যস্ত রাখার জন্য বাসা বানানোর জন্য খড়কুটো দেই। নিজের তৈরি খাবার খাওয়াই। প্রতিদিন শাক-সবজি জাতীয় খাবার দেই। পাখির জন্য সময় বেশি দেওয়ায় ছাদ বাগানে সময় একটু কম দিতে পারি। কয়েক রকমের বনশাই জাতীয় গাছ রয়েছে। কিছুদিন পর পাখিদের ডিম পাড়া শুরু হবে। তখন যত্ন আরও বাড়িয়ে দিতে হবে। 

ভেদরগঞ্জ থেকে পাখি কিনতে আসা মাহবুব শিকদার বলেন, আমি শখের বসে পাখি পালি। রাব্বি ভাইয়ের কাছ থেকে পাখি নিলে এগুলো ভালো ব্রিড করে। তিনি পাখিকে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ান। এর আগেও বেশ কয়েকবার তার কাছ থেকে পাখি নিয়েছি। 

ফজলে রাব্বির ভাই ফয়সাল কাজী বলেন, প্রতিদিন সকালে সূর্য দেখার আগেই পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। প্রথম প্রথম খারাপ লাগতো, এখন লাগে না। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাখি কেনার জন্য ও দেখার জন্য মানুষ আসে। মাঝে মধ্যে মনে হয় ছোট একটি পাখির চিড়িয়াখানায় বসবাস করছি। তারপরও ভালো লাগে। মাঝেমধ্যে কাজের ফাঁকে আমিও পাখির যত্ন নিই। তাদের খাবার খাওয়াই।

রাব্বির প্রতিবেশী প্রাইম কম্পিউটার অ্যান্ড টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ জাকির হোসেন বলেন, আমি এখানে ২১ বছর ধরে আছে। রাব্বি ২০০৪ সালে কিংবা ২০০৫ দিকে ডামুড্যা আসে। তখন দেখতাম ছাদে কবুতর লালনপালন করতো। তার পাখির প্রতি অগাত ভালোবাসা ছিল। পরে নিজের বারান্দায় পাখি পালন শুরু করে। এখন ছাদে তার বড় একটি পাখির খামার আছে। পাখি পালন করে এখন সে ভালো আছে। 

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এফ এম এ মালেক ঢাকা পোস্টকে বলেন, শখের বসে অনেকেই পাখি পালন করেন। এগুলো পালন করে স্বাবলম্বী হওয়ার সম্ভবনাও রয়েছে। আমরা উদ্যোক্তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করে থাকি। তাদেরকে বিভিন্ন সময় পাখির রোগবালাই ও কখন কী ধরনের ভ্যাকসিন দিতে হবে তার পরামর্শ দিয়ে থাকি। 

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর