প্রধানমন্ত্রীসহ ১২০০ নম্বর মুখস্থ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী দুই ভাইয়ের
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী দুই ভাই শাহিন মিয়া (৩১) ও সাজু ইসলাম (২২)। বড় ভাই শাহিন কোরআনে হাফেজ। চোখের দৃষ্টি না থাকলে কি হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রী, এমপি ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ গ্রামের ১২০০ মানুষের নম্বর তাদের মুখস্থ। শুধু তাই নয়, ফোনের বাটন টিপে তারা যে কাউকে ফোন দিতে পারেন। তাদের এই প্রতিভা ও প্রখর স্মরণশক্তি দেখে মুগ্ধ এলাকাবাসী।
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তার তীরবর্তী উত্তর সিন্দুর্না গ্রামের দিনমজুর নুর ইসলাম ও ছালেহা খাতুন দম্পতির ছেলে তারা। এই দম্পতির তিন ছেলের মধ্যে বড় ও ছোট ছেলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। মেজ ছেলে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন।
বিজ্ঞাপন
প্রতিবেশীরা জানান, জন্মের পর থেকেই দুই ভাই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। বাবা দিনমজুর হলেও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী দুই ভাইয়ের আবদার সব সময় পূরণ করেন। ২০০৯ সালে দুই ভাইকে কিনে দেন মোবাইল ফোন। পাশাপাশি বড় ভাই শাহিনকে স্থানীয় একটি মাদরাসায় কোরআন শিক্ষার জন্য ভর্তি করেন। শাহিন ইমামের মুখ থেকে শুনে শুনে কোরআন শরীফ মুখস্থ করেন। বাড়িতে ফিরে স্থানীয় একটি মসজিদে রমজান মাসে তারাবি নামাজের ইমামতি করেন। ইমামতি থেকে যে টাকা পেয়েছিলেন, সেই টাকায় বাড়িতে ফ্লেক্সিলোডের দোকান দেন।
বিজ্ঞাপন
দুই ভাই মিলে শুরু করেন ফ্লেক্সিলোডের দোকান। ফ্লেক্সিলোডের টাকা হাতে নিয়ে তারা বুঝতে পারেন সেটি কত টাকার নোট। ফ্লেক্সিলোডের জন্য কেউ ফোন করলেও তাদের কণ্ঠ শুনে মুখস্থ নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দেন। বেশ ভালোই চলছিল তাদের ফ্লেক্সিলোডের ব্যবসা। কিন্তু অভাবের সংসারে বন্ধ হয়ে যায় তাদের ব্যবসা। এতে তাদের পুরো পরিবারটি পড়েছে অভাব অনটনে। বাবা-মা এখন অন্যের বাড়িতে কাজ করে। সেই টাকায় খুব কষ্টে চলে ছয় সদস্যের সংসার।
এত নম্বর কিভাবে মনে রেখেছেন জানতে চাইলে তারা বলেন, জন্মের পর থেকেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আমরা দুই ভাই। বড় হয়েও বাবা-মায়ের কাছে বোঝা হয়ে আছি। তাই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে একজনের সহযোগিতা নিয়ে মাত্র এক হাজার টাকায় ফ্লেক্সিলোডের ব্যবসা শুরু করি। তিস্তার মানুষসহ চেয়ারম্যান-মেম্বার ফ্লেক্সিলোড করেছেন। তারা একবার নম্বর বললেই মুখস্থ হয়ে যেত। আবার অনেকেই ফোন করে ফ্লেক্সিলোড নিতেন। তাদের কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারতাম তিনি কে? তার নম্বর মনে রেখে ফ্লেক্সিলোড দিতাম পরবর্তীতে। এভাবেই সবার নম্বর মনে রেখেছি।
হাফেজ শাহিন মিয়া বলেন, পরিবারের বোঝা হয়ে না থাকতে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। কিন্তু অভাবের সংসারে ব্যবসা ঠিকভাবে করতে পারিনি। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়ে সবচেয়ে বড় কষ্ট আমার বাবা-মা ও স্ত্রী-ছেলে সন্তানকে দেখতে পারি না। কোনো কাজ করতে না পারায় স্ত্রীর চাওয়া-পাওয়া পূর্ণ করতে পারি না। যদি সমাজের কেউ এগিয়ে এসে সাহায্য করে তাহলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়েও সমাজে কিছু করে দেখাতে পারব।
ছোট ভাই সাজু ইসলাম বলেন, দিনমজুরি ও অন্যের জমিতে কাজ করে কোনো মতে সংসার পরিচালনা করেন বাবা। স্থানীয় কয়েকজনের কাছে জানতে পারি, প্রতিবন্ধী ভাতা দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। তাই হাতীবান্ধায় সমাজসেবা অফিসে যোগাযোগ করি। কিন্তু তারা আমাকে দেয়নি ভাতা। ওই দিন ৩৩৩ নম্বরে ফোন দিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ সবার নম্বর সংগ্রহ করে তাদের নম্বর মুখস্থ করি। প্রতিবন্ধী ভাতা ও সরকারি পাকা ঘরের জন্য বিভিন্ন মানুষের কাছে নম্বর সংগ্রহ করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী, লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক ও সরকারি বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলছি। পরে ভাতা ও একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দেন।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে অনেক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রয়েছেন। তাদের জন্য আলাদা করে সরকার কোনো ব্যবস্থা নিলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরাও অনেক কিছু করে দেখাতে পারবে। তাই তাদের অবহেলা না করে সহযোগিতা করুন।
বাবা নুর ইসলাম বলেন, তিস্তা নদীতে বসতবাড়িসহ সবকিছু হারিয়ে বর্তমানে নিঃস্ব। স্ত্রীসহ দিনমজুরির কাজ করে অতি কষ্টে ছয়জন সদস্যের সংসার চলে। এত বড় পরিবার নিয়ে বড় কষ্টে দিন কাটছে আমাদের। এই কষ্টের সমাধান আল্লাহ আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ সমাধান করতে পারবে না। বর্তমানে টাকার অভাবে ফ্লেক্সিলোডের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু দিন আগে মুদির দোকান ও গাভী পালন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছে দুই ছেলে। স্থানীয় প্রশাসন সহযোগিতা করলে তাদের পুনর্বাসন করা সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে হাতীবান্ধা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মাহাবুর আলম জানান, ওই দুই ভাই যোগাযোগ করার সঙ্গে সঙ্গে ভাতার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। সরকারি কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হলে তাদের অবশ্যই দেওয়া হবে।
হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সামিউল আমিন বলেন, সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে তাদের বিষয়ে জানতে পেরেছি। তাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা রয়েছে। ‘জমি আছে ঘর নেই’ প্রকল্পের আওতায় পাকা ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। সেই ঘরেই তারা থাকছেন বলে জানতে পেরেছি।
এসপি