সকাল গড়িয়ে দুপুর। সবুজে ঘেরা অপরূপ সৌন্দর্যের চোখজুড়ানো মাঠ চারপাশে। মাঝখানে একখণ্ড উঠান। এখানেই চলছে হাঁডাক, হুড়োহুড়ি, ব্যস্ততা। কাছে গিয়ে দেখা গেল তোড়জোড় শুরু হয়েছে রান্নার পর্বের। দলবেঁধে নারীরা রান্নার কাজে ব্যস্ত। একই রকমের পোশাক পরে বিভিন্ন বয়সের ১৪ জন নারীর দম ফেলার ফুরসত নেই। দেখে মনে হচ্ছিল বিয়ে অথবা অন্য কোনো আনন্দ-উৎসবের আয়োজন চলছে।

তাদের সবাই গৃহিণী। কেউ কলা-আলু কাটছেন, কেউ ডিম ধোয়ায় ব্যস্ত। কেউ ব্যস্ত পেঁয়াজ-রসুন-মরিচ নিয়ে, কেউ চাল ধুচ্ছিলেন, একজন চুলা জ্বালাচ্ছিলেন। শিলপাটায় ছন্দের তালে অবিরাম মসলা বাটার কাজ করছিলেন অন্যরা।

বিয়েবাড়িতে যেমন আত্মীয়স্বজন বা রাঁধুনিদের খুনসুটি, মহোল্লাস ও হইহুল্লোড়ে প্রাণবন্ত থাকে, তেমনই মনে হচ্ছিল দূর থেকে দেখে। কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অন্য কোনো উৎসব নয়, সেখানে ইউটিউব গ্রামের কার্যক্রম চলছে। এসব দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করে ইউটিউবে আপলোড করা হবে।

ইউটিউবে যাদের সবাই দেখে, যে গ্রামের সামাজিক পরিচিতি সারা বিশ্ব থেকে, তাদের জীবনকথা জানতেই সরেজমিনে গত শনিবার (২১ আগস্ট) এই প্রতিবেদক গিয়েছিলেন কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামে। ‘ইউটিউব গ্রাম’ কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়নের শিমুলিয়া গ্রামে অবস্থিত। বাংলাদেশ একমাত্র ইউটিউব গ্রামটি চিরসবুজে ঘেরা বিশুদ্ধ বাতাসে পরিপূর্ণ শান্ত ও সুন্দর।

জানা যায়, ছোট্ট গ্রামটিতে নারীদের দলবেঁধে রান্না করা, গ্রামের শত শত মানুষকে বিনামূল্যে খাওয়ানো, থিমপার্ক, মানুষের ইচ্ছাপূরণ, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করার ভিন্নধর্মী কার্যক্রমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াই ভিডিও করে ‘অ্যারাউন্ড মি বিডি’ নামের ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করা হয়। সেসব ভিডিও দেশ-বিদেশে ব্যাপক ভাইরাল হয়। এ জন্য এ গ্রামটি এখন পৃথিবীর বহু দেশের মানুষের কাছে ‘ইউটিউব গ্রাম’ নামে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তাই গ্রামটিকে ‘ইউটিউব গ্রাম’ বলে ডাকেন।

‘অ্যারাউন্ড মি বিডি’ অনেকের কাছেই পরিচিত। ইউটিউব চ্যানেলটিতে কখনো রান্নার আয়োজন, অভিনব উপায়ে খালে-বিলে মাছ ধরা, অতিকায় হাতি-ঘোড়া বানিয়ে শিশুদের দুরন্তপনার ভিডিও আপলোড করা হয়। বর্তমানে অ্যারাউন্ড মি বিডির সাবস্ক্রাইবার প্রায় ৩ দশমিক ৭২ মিলিয়ন।

সরেজমিনে আরও দেখা যায়, ইউটিউব গ্রামখ্যাত মোল্লপাড়া এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ইউটিউব গ্রামের পরিচালক দেলোয়ার হোসেনের বাড়ির পাশে উঁচু একটি জায়গায় টিনের ছাপড়া ঘরে (দেয়াল ছাড়াই বাঁশের খুঁটির ওপর টিনের চাল) নিচে চলছে এসব কার্যক্রম।

শুধু তা-ই নয়, খোকসার শিমুলিয়ায় বাঁশ-খড়সহ গ্রামীণ জিনিসপত্র দিয়ে তৈরি করা হয়েছে একটি থিমপার্ক। এ পার্ক কীভাবে তৈরি করা হয়েছে, তা নিয়েও ভিডিও ছাড়া হয় ইউটিউবে। সহজ, সরল গ্রামীণ জীবনে আনন্দ দিতে গেলে নিজেদের চেষ্টায় যতটা করা সম্ভব, সবই যেন করা হচ্ছে এই ইউটিউব গ্রামে। সেখানকার নয়নাভিরাম দৃশ্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে।

নোমান নামের একজন ইউটিউব গ্রামে বাঁশ দিয়ে একটি পুকুরের মধ্যে পানির ওপর ঘর বানাচ্ছিলেন। আলাপকালে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই ইউটিউব গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের বাঁশ-খড়ের তৈরি জিনিস রয়েছে। সেগুলো আমার তৈরি। সেসব দৃষ্টিনন্দন লাভ, বাড়ি, ব্যাঙের ছাতা আমার হাতেই তৈরি করা। বর্তমানে পানির ওপর পুকুরের মধ্যে ঘর তৈরির কাজ করছি। এসব আমার ডিজাইন করা। আমার সঙ্গে কয়েকজন সহকারী রয়েছে। এসব তৈরির ভিডিও আমাদের ইউটিউবে ছাড়া হয়।

তিনি বলেন, মানুষকে বিনামূল্যে এসব খাবার পরিবেশন করা হয়। ভিডিওগুলোয় কোনো উপস্থাপনা নেই, নেই কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। গ্রামের মানুষের সহজাত কথা-বার্তাগুলোই স্বাভাবিক শব্দে হুবহু তুলে ধরা হয়। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ধারণা করা, ইউটিউবের এ চ্যানেলের প্রতিটি ভিডিওর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপভোগ করে উৎসুক দর্শক।

রান্নায় জড়িত মদিনা খাতুন বলেন, আমাদের ইউটিউব গ্রামকে এখন বিশ্ববাসী চেনেন। আমি এখানে ‘অ্যারাউন্ড মি বিডি’ গ্রুপে কাজ করি। আমার সঙ্গে আরও ১৪ থেকে ১৫ জন নারী রান্নার কাজ করেন। আমরা খুব আনন্দ করি। সবাই একই ধরনের পোশাক পরি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করি। এই কাজ করে আমরা সম্মানিত ও স্বাবলম্বী হয়েছি।

দলের সদস্য শারমিন খাতুন বলেন, লকডাউনের আগে মাসে ১৫ থেকে ২০ দিন রান্না করা হতো। লকডাউন চলাকালীন এ কার্যক্রম বন্ধ ছিল। লকডাউন শেষ হওয়ার পর আবারও ইউটিউব গ্রাম ফিরে পেয়েছে প্রাণ। শুরু হয়েছে ‘অ্যারাউন্ড মি বিডি’র কার্যক্রম। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেদিন রান্নার কাজ থাকে, সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের বাড়ির কাজ সেরে ১০টার মধ্যে নির্ধারিত পোশাক পরে সবাই নির্ধারিত জায়গায় উপস্থিত হই। তারপর সবাই মিলে রান্না শুরু করি। বিকেল ৩ থেকে ৪টার মধ্যে রান্নার কাজ সম্পন্ন হয়। তারপর ৫টার মধ্যে গ্রামের শত শত মানুষ প্লেট-বাটি-গামলা নিয়ে খাওয়ার জন্য উপস্থিত হয়।

তিনি বলেন, তাদের খাওয়ানোর শেষে আমরা খাই। তারপর রান্নার কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্র পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখি। অবশিষ্ট খাবার থাকলে আমরা ভাগাভাগি করে বাড়ি নিয়ে যাই সন্ধ্যার দিকে। দিনভর আমরা খুব আনন্দে কাটাই। সেই ছোটবেলার বনভোজনের মতো উৎসব মনে হয় এই উৎসবমুখর আয়োজনকে।

চারপাশ ক্যামেরাবান্দি করেন যিনি, তিনি আশাদুল ইসলাম বলেন। তিনি বলেন, আমার কাজ ভিডিও করা। আগে বেকার ছিলাম। বেকারত্ব ঘুচিয়ে চার বছর ধরে এই কাজ করছি। সকাল ১০টায় রান্না শুরু থেকে বিকেলে গ্রামের মানুষকে খাওয়ানো পর্যন্ত আমি কাজ করি। সারা দিনে ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ ঢাকায় পাঠিয়ে দিই। সেখান থেকে এডিট করে ‘অ্যারাউন্ড মি বিডি’ নামের ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করা হয়।

এক প্রশ্নের জবাবে আশাদুল বলেন, এই কাজ করা উৎসবে অংশগ্রহণ করার মতো আনন্দের। আমাদের এসব ভিডিওর মাধ্যমে দেশ-বিদেশের মানুষ আমাদের সম্পর্কে জানতে পারে। আমরা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছি। অনেক দর্শনার্থী ঘুরতে আসেন এখানে। তা ছাড়া আমি এ কাজ করে অর্থ উপার্জন করি। প্রতি মাসের বেতনের টাকা দিয়ে আমাদের সংসার চলে। আমি পরিবার নিয়ে এখন ভালো আছি। আমার মতো অনেকেই এ কাজ করে জীবন যাপন করে।

রান্না করতে করতে বৃদ্ধা স্বর্ণা খাতুন বলেন, চার-পাঁচ বছর ধরে আমরা এই কাজ করছি। খুবই ভালো লাগে। আমরা রান্না করি আর গ্রামবাসীরা সবাই মিলে একসঙ্গে খাই। অবশিষ্ট যে খাবার বাঁচে, তা আমরা ভাগাভাগি করে বাড়ি নিয়ে যাই। মাসে মাসে বেতন পাই। সেই টাকায় সংসার চলে, ওষুধ কিনি।

খাওয়ার সময় কয়েকজন শিশু বলে, যেদিন রান্না হয়, সেদিন আমরা এখানে খেতে আসি। অনেক মজা করে আমরা খাই। অন্যদিন গোশত দেয়। আজ ডিম দিয়েছে। একেক দিন একেক ধরনের খাবার খেতে দেয়। আমরা অনেক আনন্দ করি।

এ বিষয়ে স্থানীয়রা জানান, এ কার্যক্রমের মাধ্যমে বিনামূল্যে গ্রামের মানুষকে খাওয়ানো হয়। ইউটিউবের মাধ্যমে গ্রামীণ জীবন তুলে ধরা হচ্ছে বিশ্বের মানুষের সামনে। আমাদের গর্বের বিষয় এটি। এটির মাধ্যমে আমাদের গ্রাম ও গ্রামের মানুষের উন্নয়ন হচ্ছে। দেশ-বিদেশের বিখ্যাত মানুষ ঘুরতে আসেন এখানে।

‘অ্যারাউন্ড মি বিডি’ চ্যানেলের মালিক ও অ্যাডমিন সফটওয়্যার প্রকৌশলী লিটন আলী বলেন, পরিকল্পনা ছাড়াই প্রথমে শখের বসে আমি একটি ইউটিউব চ্যানেল খুলে সেখানে বিভিন্ন ধরনের ভিডিও আপলোড করতাম। পরে ২০১৬ সালে আমার মামা দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করে অ্যারাউন্ড মি বিডির কার্যক্রম শুরু করি।

আমি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) পড়াশোনা করেছি। ঢাকায় আমার তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানও আছে। আমি ঢাকাতেই থাকি। আর আমার মামা গ্রামে থেকে সব কার্যক্রম পরিচালনা করেন। চ্যানেলের জন্য গ্রামে চারজন ফটোগ্রাফার, ঢাকায় চারজন ভিডিও এডিটর কাজ করেন। আমি ভিডিওগুলো আপলোড করি।

ইউটিউব চ্যানেল থেকে আয়ের বিষয়ে তিনি জানান, শুরুর দিকে আয়-উপার্জন ছিল না। পকেটের টাকা ব্যয় করে কার্যক্রম চলত। এখন দেশ-বিদেশে আমাদের চ্যানেল খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ইউটিউব থেকে এখন ভালোই উপার্জন হয়। সেখান থেকে প্রতি মাসে ৫০ জনকে সম্মানী দেওয়া হয়। এখন আমি গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করতে পারছি। পাশাপাশি অসহায় মানুষের মুখে সামান্য খাবার তুলে দিতে পারছি, বেকারকে চাকরি দিতে পারছি। এর চেয়ে আনন্দের কিছু নেই।

ভবিষ্যতে আমাদের কার্যক্রমের পরিধি আরও বাড়ানোর স্বপ্ন রয়েছে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করা।

ভিন্নধর্মী এ কার্যক্রমের পরিচালক শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, রান্নার দিন সবাই খুব আনন্দে থাকি। সকাল থেকে রান্না শুরু হয়। বিকেলে গ্রামের শত শত মানুষ একসঙ্গে খাই। আয়োজনে পোলাও, বিরিয়ানি, গরু, খাসি, মুরগির মাংস, বড় মাছ, ছোট মাছ, ডিমসহ বিভিন্ন রকমের খাবার পরিবেশন করা হয়। আজ ৬০ কেজি চাল, ১০টি গাছের কলা, ৫০০ ডিম ও আলু রান্না করা হয়েছে। ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষকে খাওয়ানো হয়। খরচ হয়েছে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা।

এসব কাজে সবাইকে সম্মানী দেওয়া হয়। তা ছাড়া অসহায় ও বিপদগ্রস্ত অসহায় মানুষদের আমরা সাহায্য করে থাকি। গ্রামের মানুষ মেলার মতো আনন্দের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে। লকডাউনের কারণে আমাদের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। লকডাউন শেষে আমরা আবার আমাদের কার্যক্রম শুরু করেছি। ভবিষ্যতে আমরা আরও ভালো কাজ করতে চাই। যাতে এলাকা ও এলাকার মানুষের উন্নয়ন ঘটে।

এনএ