দেশের একমাত্র উৎপাদনশীল দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মধ্যপাড়া পাথর খনির বর্তমান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়ামের চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী সেপ্টেম্বর মাসে। নিয়ম অনুযায়ী, চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার অন্তত ছয় মাস আগে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত পেট্রোবাংলা জিটিসির সঙ্গে মেগা প্রকল্পের চুক্তির মেয়াদ বাড়বে নাকি আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ হবে সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

জানা গেছে, মধ্যপাড়া পাথর খনিটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিটিসির হাতে তৃতীয়বারের মতো লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এখন এই লাভজনক প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পেট্রোবাংলা পাথর খনির ঠিকাদার নিয়োগে আর্ন্তজাতিক দরপত্র আহ্বান করে ৭ দফা তারিখ পরিবর্তন করেলেও করোনা মহামারির কারণে বিদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাড়া মেলেনি। ফলে আর্ন্তজাতিক দরপত্র বাতিল করা হয়েছে।

খনির পাথর উত্তোলন, উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা কাজে নিয়োজিত বেলারুশ ভিত্তিক কোম্পানি জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি) ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করতে পারেনি পেট্রোবাংলার মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (এমজিএমসিএল)। নতুন করে আর্ন্তজাতিক দরপত্রের মাধ্যমে এই মেগা প্রকল্পটিতে নতুন কোনো ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে? নাকি বর্তমান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি হবে এই নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশের একমাত্র এবং বৃহৎ পাথর খনিটি।

ফলে আবার এই খনিটি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বছরে রেকর্ড পরিমাণ ১.৬ মিলিয়ন টন পাথর উত্তোলন। মধ্যপাড়া পাথর খনিটির উৎপাদন বন্ধ হলে দেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালসহ মেগা প্রকল্পগুলো বিপাকে পড়তে পারে।

অন্যদিকে খনি বন্ধ হয়ে গেলে এখানে কর্মরত ৭ শতাধিক খনি শ্রমিকসহ প্রায় ১ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মহীন হয়ে পড়বে।

খনি কর্তৃপক্ষের রহস্যজনক ভূমিকার কারণে পাথর খনির নতুন ঠিকাদার নিয়োগের কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় ধারাবাহিকভাবে তিন বার লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া পাথর খনিটি আবার বন্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মধ্যপাড়ার পাথর উত্তোলনের কারণে জিটিসির মেয়াদকাল আরও এক দফা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এই বিষয়ে অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে। কিন্ত তারপরও ষড়যন্ত্রকারী মহল রহস্যজনক কারণে চুক্তি নিয়ে নানা টালবাহানা শুরু করছে।

খনিটিকে সচল রাখতে ২০১৩ সালে ২ সেপ্টেম্বর বেলারুশভিত্তিক কোম্পানি জার্মানিয়া-ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি) এর সঙ্গে চুক্তি করা হয়। নানা প্রতিকূলকতা পেরিয়ে তারা পাথর উত্তোলনের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে। প্রতিদিন তিন শিফটে সাড়ে ৫ হাজার মেট্রিক টন পাথর উত্তোলনের যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে খনিটি চালু করা হয়েছিল, একমাত্র জিটিসিই সেই লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে এক দিনে তিন শিফটে ৬ হাজার মেট্রিক টন পর্যন্ত পাথর উত্তোলন করে তাদের সক্ষমতা দেখিয়েছে।

শতাধিক বিদেশি খনি বিশেষজ্ঞ ও অর্ধশত দিশি প্রকৌশলী এবং সাড়ে ৭০০ দক্ষ খনি শ্রমিক দিনে-রাতে রেকর্ড পরিমাণ পাথর উত্তোলন করায় মধ্যপাড়া পাথর খনি কর্তৃপক্ষ ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে লোকসানের কলঙ্ক ঘুচিয়ে প্রায় ৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা প্রথমবারের মতো লাভের মুখ দেখে।

২০১৯-২০২০ অর্থবছরে প্রায় ২২ কোটি টাকা মুনাফা করে দ্বিতীয়বার লাভজনক প্রতিষ্ঠানের ধারা অব্যাহত রাখে পাথর খনিটি। চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরেও খনিটি লাভের মুখ দেখেছে। সেই সঙ্গে পাথর বিক্রি থেকে ভ্যাট ও ট্যাক্সসহ কয়েক কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা হয়েছে। এতে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়েছে। এই অবস্থায় নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে নাকি বর্তমান ঠিকাদারের মেয়াদ নবায়ন এই নিয়ে চলছে টানাপোড়েন।

নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক এক প্রকৌশলী জানান, বৈশ্বিক মহামারির কারণে প্রায় দেড় বছর ধরে মধ্যপাড়ার পাথর খনির পার্শ্ববর্তী বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিএমসি-এক্সএমসি। সেখানে চাকরি না থাকায় সহশ্রাধিক খনি শ্রমিকের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমিক চাকরি হারিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। খনি বন্ধ থাকায় সেখানে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে এবং শ্রমিক আন্দোলন চলছে। অথচ এই মহামারির মধ্যেও কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে মধ্যপাড়া পাথর খনির উৎপাদন কাজ অব্যাহত রেখেছে জিটিসি। ফলে করোনার মধ্যেও খনিটি এই অর্থবছরে আবারও লাভের মুখ দেখেছে।

এসপি