ঘরের কোণে চলে এসেছে ভৈরব, কাঁদছেন মেহেরুন
ষাটোর্ধ্ব মেহেরুন বেগম। বিষণ্ন মনে বসে আছেন ভৈরব নদীর পাড়ে। নদীর দিকে তাকিয়ে আছেন আর ভাবছেন এই নদীই কয়েক বছরে তিন তিনবার কেড়ে নিয়েছে তার বসতবাড়ি। আবার ভাঙতে ভাঙতে চলে এসেছে ঘরের কোণে। এই এক চিলতে ঘরছাড়া যে তার কোনো সম্বল নেই।
নেই স্বামী-সন্তান। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাই তো নীরবে চোখের জল ফেলছেন। আর অসহায় আকুতি জানাচ্ছেন একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়ার। বাগেরহাট সদর উপজেলার বারুইপাড়া ইউনিয়নের কার্তিকদিয়া পূর্বপাড়া এলাকার বাসিন্দা তিনি।
মেহেরুন বেগম বলেন, ‘আমার তিনখেন ঘরবাড়ি নদীতে চলে গেইছে। শেষ সম্বল একখান ঘর তাও নদীতে চলে যাচ্ছে। আমার স্বামী নেই, সন্তান নেই। ৩৫ বছর আগে স্বামী মারা গেছে। আমি একদম অসহায়, নিরুপায়। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই আমার।’
বিজ্ঞাপন
‘রাতে ভয়ে ঘুম হয় না। কখন জানি নদী টান মেরে ঘর নিয়ে যায়। ঘর চলে গেলে এর সাথে আমারও ভেসে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না’ বলে কাঁদতে থাকেন বৃদ্ধা এই নারী।
শুধু মেহেরুন বেগমই নয় এই এলাকার গোলজান বেগম, ওহিদ মোড়ল, ছায়েরা বেগম, মিনু বেগমসহ ২০টি পরিবার রয়েছেন ভাঙনঝুঁকিতে। ভাঙন রোধ করতে অতি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয়রা বলেন, আমাদের গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই হতদরিদ্র। ভৈরব নদী ভাঙতে ভাঙতে গ্রামের অনেক বাড়িঘর বিলীন হয়ে গেছে। অনেকের আর সরে যাওয়ার জায়গা নেই। বৃষ্টির মৌসুম আসলেই গরু-বাছুর, গাছপালাসহ মূল্যবান সম্পদ নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হয়।’
বিজ্ঞাপন
ছায়েরা বেগম নামের একজন বলেন, ‘নদীর পাড়ে আমরা থাকি। বৃষ্টি-জোয়ারে পানি ওঠে সব তলায়ে যায়। জোয়ারের পানি দুইবারই ওঠে। রান্নার চুলাও ডুবে যায়। এই নিয়ে আমরা খুব সমস্যায় আছি। সরকারের কাছে চাই এই জাগায় যেন স্থায়ী বান্ধা (বাঁধ) দিয়ে দেয়। পানি যাতে আর কোনোদিন না ওঠে।’
স্থানীয় ওহিদ মোড়ল জানান, ‘দুই বিঘা জমি চলে গেছে নদীগর্ভে। তিনবার ঘর হারিয়েছি। এভাবে চলতে থাকলে নিজের বলতে আর কিছু থাকবে না। জানমাল রক্ষার জন্য স্থায়ী বাঁধ দেওয়া প্রয়োজন।’
মিনু খাতুন বলেন, ‘ছেলে-মেয়ে নিয়ে এই জায়গায় থাকতে পারতিছি না। রান্না করেও খাওয়ার উপায় নেই। আমরা সরকারের কোনো অনুদানও পাই না। রাতে সব নদীতে চলে যাওয়ার ভয় থাকে। কিছু হলে ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে কই যাব?’
রাকিব বিশ্বাস ও হাসান মোড়োল জানান, ‘নদী আর ঘর এক হয়ে গেছে। বাপ-দাদার সম্পত্তি, গাছ-পালা সব নদীতে চলে গেছে। আগে এখানে হাট বসত। আর এখন হাটের কোনো অস্তিত্ব নেই। আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করছি যতদ্রুত সম্ভব নদী শাসন করে আমাদের নিরাপত্তা দিন।’
এদিকে শুধু কার্তিকদিয়ার পূর্বপাড়াই নয়, সদর উপজেলার বিষ্ণুপুর ও বারুইপাড়া ইউনিয়নে প্রায় অর্ধশত পরিবারের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বড় বড় ফাটল ধরেছে বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের কুড়ামারা গ্রামের ভৈরব নদীর পাড়ে।
ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে আলোর ঘাট, আমতলা ঘাট, জেলেপাড়া দারোগার ঘাট, চড়কুলিয়া দাইরসহ বিভিন্ন গ্রাম। এমন অবস্থায় স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ভাঙনঝুঁকিতে থাকা এ পরিবারগুলো ঘরবাড়ি রক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শংকর চক্রবর্তী বলেন, ভাঙনের ফলে বিস্তীর্ণ কৃষি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। অনেক মানুষ বাস্তুহারা হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। টেকসই বাঁধ নির্মাণ করে দ্রুত জনগণের কষ্ট লাঘব করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এই জনপ্রতিনিধি।
বাগেরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুছাব্বেরুল ইসলাম বলেন, সদর উপজেলার কিছু এলাকায় ভাঙন প্রবণতা দেখা দিয়েছে। আমরা সরেজমিনে পরিদর্শন করে লিখিত প্রতিবেদন আকারে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করব।
এমএসআর