র‌্যাবের গুলিতে পা হারানো সেই লিমন হোসেন বিয়ে করেছেন। শুক্রবার (০৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর এলাকার সরখোলা গ্রামের টিটো মোল্লার একমাত্র মেয়ে রাবেয়া বসরীর (১৯) সঙ্গে ২ লাখ টাকা দেনমোহরে তার বিয়ে সম্পন্ন হয়। 

লিমন হোসেন ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামের তোফাজ্জেল হোসেনের ছেলে। শুক্রবার বিয়ে উপলক্ষে ১০ জনের বরযাত্রী বৃহস্পতিবার (০২ সেপ্টেম্বর) যশোরে চলে আসেন। বরযাত্রীর মধ্যে ছিলেন লিমন হোসেনের বাবা-মা ও নিকট আত্মীয়রা। দুপুর ১২টার দিকে বরযাত্রী কনে রাবেয়া বসরীর বাড়িতে পৌঁছান। জুমার নামাজের আগেই ২ লাখ টাকা কাবিনে বিয়ে পড়ান স্থানীয় কাজি। করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে দুই পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে ছোট পরিসরে উৎসবমুখর পরিবেশে এই বিয়ে সম্পন্ন হয়।

১০ বছর আগে র‌্যাবের গুলিতে লিমনের পা হারানোর ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় লিমনের পা হারানোর ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হয়। প্রশ্নের মুখে পড়েছিল র‌্যাবের ওই অভিযান। সেই লিমন এখন গণবিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী প্রভাষক। 

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গণবিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ফুয়াদ হোসেনের বাড়িও অভয়নগরের সরখোলা গ্রামে। তিনিই এই বিয়ের মধ্যস্থতা করেছেন। কনে যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর এলাকার সরখোলা গ্রামের কৃষক টিটো মোল্লার মেয়ে রাবেয়া বসরী দুই ভাই-বোনের মধ্যে বড়। রাবেয়া এ বছর নওয়াপাড়া কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষার্থী।

সাভারের গণবিশ্বাবিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের প্রধান ড. ফুয়াদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, লিমন খুব ভালো ছেলে। আমার মধ্যস্থতায় এই দুই পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তার বাধনের সৃষ্টি হয়েছে। লিমন যখন সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ছিল তখনই আমার সঙ্গে পরিচয় হয়। তারপর এখন তো লিমন আমার সহকর্মী। আমরা একই সঙ্গে সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করি। 

তিনি আরও বলেন, লিমনের জীবনে একটি দুর্ঘটনা রয়েছে। এটা একান্তই দুর্ঘটনা। ওই ঘটনায় তার কোনো দায় ছিল না। সমাজের ওই জায়গা থেকে লিমনের এ দুর্ঘটনাটিকে সম্মান করি। সেই সঙ্গে তিনি নিজের যোগ্যতা আজকে প্রমাণ করতে পেরেছে। একই সঙ্গে সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছেন। এসব দেখেই আমার প্রতিবেশী বোন রাবেয়া বশরীকে লিমনের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেই । তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করি।

কনে রাবেয়া বশরীর বড় চাচা আহসান হাবিব খোকন বলেন, লিমন খুব ভালো ও উদ্যোমী ছেলে। সৎ, সাহসী ও দৃঢ় মনোবল শক্তির মানুষ না হলে লিমনের সঙ্গে যেটা ঘটেছে তারপর সে দাঁড়াতে পারতো না। লিমন ব্যতিক্রম। সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। লিমনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি দুর্ঘটনা বলেই আমরা ধরে নিয়েছি। আমরা লিমনের সঙ্গে আমাদের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। লিমনের মতো আরও অনেকেই আমাদের আশেপাশে রয়েছে। এদেরকে উৎসাহ দেওয়ার জন্যই আমরা দুই পরিবার মিলেই এই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। 

কনের বাবা টিটু মোল্লা বলেন, দুই পরিবারের সিদ্ধান্তেই বিয়ে হয়েছে। আমার মেয়ে ও জামাইয়ের জন্য সবাই দোয়া করবেন।

বিয়ের অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের লিমন বলেন, বাবা-মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করছি। বৃহস্পতিবার নিজ বাড়িতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হয়েছে। 

তিনি বলেন, আমার এ পর্যন্ত আসার পেছনে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বাংলাদেশের সকল গণমাধ্যমকর্মী ও মাধবাধিকার কমিশনের অবদান কখনো ভুলতে পারব না। এছাড়া ঝালকাঠির স্থানীয় সাংবাদিকদের কথাও ভোলা যাবে না। আমার বিয়েতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আসতে চাইলেও অসুস্থতার কারণে আসতে পারেননি। তার কাছে দোয়া চেয়েছি। বাবা-মাকে সবসময় সাহস দিতাম, আমাদের সুদিন আসবে, আমরা ঘুরে দাঁড়াব। 

অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বেন বলেই আইন বিষয়ে পড়েছেন বলে জানান লিমন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি প্রতিবন্ধী জেনেও আমার স্ত্রী রাবেয়া বশরী আমাকে মনে প্রাণে মেনে নিয়েছে। দেশবাসী আমাদের জন্য দোয়া করবেন। 

কনে রাবেয়া বশরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় র‌্যাবের গুলিতে লিমনের পা হারানোর ঘটনায় দেশজুড়ে আলোচনায় আসার পর আমি তাকে চিনতাম। তিনি (লিমন) নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্যারিয়ার গড়েছেন, দাম্পত্য জীবনেও দায়িত্বশীল হবেন বুঝেই বিয়েতে রাজি হয়েছি।

লিমনের মা হোসনে আরা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১১ সালের ২৩ মার্চ বিকেলে বাড়ির কাছের মাঠে গরু আনতে গিয়ে র‌্যাবের গুলিতে পা হারায় লিমন। ওই সময় সে উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিল। পুলিশ অনেক সময় ক্ষেপণের পর ৬ র‌্যাব সদস্যের নামে রাজাপুর থানায় মামলা রেকর্ড করে। মামলা রেকর্ডের আগে ২৪ এপ্রিল অস্ত্র আইনের মামলায় লিমনের নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। ১৩ মে হাইকোর্ট লিমনের জামিন মঞ্জুর করেন। লিমন হত্যাচেষ্টা মামলায় রাজাপুর থানা পুলিশ ১৮ আগস্ট ২০১২ সালে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। সর্বশেষ রিভিশন মঞ্জুরের পর ২২ এপ্রিল ২০১৮ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শামীম রেজা লিমন হত্যাচেষ্টা মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন। বর্তমানে পিবিআইয়ের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলাম মামলাটি তদন্ত করছেন। লিমনের ওপর এই অত্যাচারের ঘটনায় দোষীদের দ্রুত বিচারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি। 

এক প্রশ্নের জবাবে হোসনে আরা বেগম বলেন, ছেলের একটা পা নষ্ট। অনেক কষ্ট আর সবার দোয়ায় লিমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আজকে আমার ছেলের বিয়ে। পুত্রবধূ রাবেয়া বশরীর পরিবার ও আমরা পরিবারের সিদ্ধান্তেই এই বিয়ে হচ্ছে। তারা যেন সুখে থাকে দেশবাসীর কাছে সেই দোয়া চাই। 

এদিকে সালাম হোসেন নামে কনের এক প্রতিবেশী বলেন, রাবেয়া এলাকায় অনন্য দৃষ্টি স্থাপন করেছে। সাহসী সিদ্ধান্তও নিয়েছে। বরের একটি পা নেই তার পরও বিয়েতে রাজি হয়েছে সে। বর্তমান যুগের মেয়েরা এমন সিদ্ধান্ত নেবে এটা বিরল। আমি তাদের দুজনের মঙ্গল কামনা করছি। তার সারাজীবন সুখে থাকুক।  

প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ২৩ মার্চ বিকেলে ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া ইউনিয়নে নিজ বাড়ির পাশের একটি বাগানে নিয়ে লিমনের পায়ের গুলি করেন র‌্যাব সদস্যরা। এরপর লিমনসহ আটজনের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা ও অস্ত্র রাখার অভিযোগে দুটি মামলা করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন লিমনকে বাঁচাতে তার গুলিবিদ্ধ পা কেটে ফেলেন চিকিৎসকরা। এরপর লিমনের মা বাদী হয়ে র‌্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে ঝালকাঠি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যাচেষ্টা মামলা করেন।

জাহিদ হাসান/আরএআর