আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নে নির্মিত প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরগুলোতে বসবাস করতে পারছেন না সুবিধাভোগীরা। জোয়ারের পানি ঢুকে পরায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে পানি ঠেকাতে ঘরের দরজায় দেয়াল তুলে দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।

একই সঙ্গে আশ্বস্ত করা হয়েছে- ঘরগুলো দুর্যোগ এবং পানির হাত থেকে রক্ষা করতে চারপাশে সীমানা প্রাচীর তুলে দেওয়া হবে। এজন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশপত্র পাঠাবেন জেলা প্রশাসক। বর্তমানে তারা ‘টেকনিক্যাল’ কমিটির সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন মাসুদ। 

তবে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের অভিযোগ, অত্যন্ত নিচু এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের স্থান নির্ধারণ করায় পুরো প্রকল্পে বিভিন্ন রকমের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।

উপজেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে, উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের বাহেরচরে প্রথম পর্যায়ে ৪০টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ঘরগুলো সঠিকভাবে নির্মাণ করা হলেও ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সেখানকার ৯টি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত এবং দুটি ঘর ভেঙে পড়ে। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে ঘরগুলো পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছে। 

এদিকে ঘরগুলো সংস্কার হলেও এখনো বসবাস করতে পারছেন না বরাদ্দপ্রাপ্তরা। তারা জানিয়েছেন, জোয়ার ভাটার ওপর নির্ভর করে ঘরগুলোতে থাকতে হয়। এমনকি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরের টয়লেট কোনোভাবেই ব্যবহার করতে পারেন না। জোয়ারের পানিতে যখন ঘরের মেঝে ডুবে যায় তখন টয়লেটে থাকা মল-মূত্র পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য বাসিন্দারা প্রকল্পের ঘরের বাইরে উঁচু করে টয়লেট নির্মাণ করে নিচ্ছেন। এছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগের কাজও শেষ হয়নি।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পাওয়া বকুল বেগম বলেন, বিদ্যুৎ দেওয়ার কাজ করা হচ্ছে। তবে আশ্রয়ণ প্রকল্পে আসা-যাওয়ার রাস্তা নেই। জোয়ারে পানি উঠে ঘরের মেঝে তলিয়ে যায়। টয়লেট ব্যবহার করতে পারি না। পানি উঠলে টয়লেট ডুবে যায়।

আরেক বাসিন্দা জানান, ছেলে-মেয়ে-নাতিসহ ৭ জন মিলে ঘরে থাকেন। ইয়াসের সময়ে ১১টি ঘরের মধ্যে যে দুটি ঘর বেশি ভেঙে পড়েছিল তার মধ্যে তার একটি। ঘরটি মেরামত করে দিলেও পানি ঠেকাতে পারছেন না। জোয়ারের সময়ে ঘরে পানি ঢুকে পড়ে, আবার ভাটায় শুকায়। এজন্য অসম্ভব দুর্ভোগে আছেন তারা।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা হাসনুর বেগম বলেন, আমাদের ঘরবাড়ি ছিল না। সরকার ঘর দিয়েছে খুব ভালো কাজ হয়েছে। কিন্তু যে ঘর পেয়েছি তার টয়লেট ব্যবহার করতে পারি না। টয়লেট করতে বাইরে যেতে হয়। জোয়ারের সময়ে হাঁটু সমান পানিতে ডুবে থাকতে হয়। তখন আর বসবাসের যোগ্য থাকে না আশ্রয়ণ প্রকল্প।

রাহিমা বেগম বলেন, ঘর বুঝে পওায়ার পর প্রথম প্রথম ঘরের মাঝের টয়লেট ব্যবহার করি। কিন্তু জোয়ারের পানি ঢুকে পুরো ঘরে মল-মূত্র ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে ঘরের মাঝের টয়লেট ব্যবহার বন্ধ রেখেছি। আর ঘরের ভেতরে পানি প্রবেশ ঠেকাতে দরজায় হাঁটু সমান উচ্চতায় দেয়াল তুলে দিয়েছে উপজেলা থেকে। দেয়াল দেওয়ার পরে পানি প্রবেশ কমলেও ঘরের চারপাশ জোয়ারের পানিতে তলিয়ে থাকায় ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে তিনি জানান।

বরিশাল তহসিল অফিসের এক কর্মচারীর স্ত্রী নাসরিন বেগম বলেন, আমরা একটি মেয়েকে লালন-পালন করে বড় করেছি। তাকে একটি ঘর এনে দিয়েছি। তিনি অসুস্থ থাকায় বরিশালে আছেন। এজন্য আমি এই ঘরে এসে থাকছি। ঘরের মধ্যে পানি ওঠে। ঘরে পানি উঠলে থাকা যায় না। অন্যত্র চলে যেতে হয়। আবার পানি শুকালে ঘরে আসতে পারি।

আমিনুল ইসলাম নামে একজন জানান, নদীতে ঘর-বাড়ি ভেঙে যাওয়ায় তিনি ও তার মা হোসনেয়ারা বেগম ঘর পেয়েছেন। তিনি বরিশাল পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে লেখাপড়া শেষ করেছেন। 

আমিনুল ইসলাম বলেন, জননেত্রী আমাদের ঘর উপহার দিয়েছেন; আমরা উপকৃত হয়েছি। কিন্তু বাহেরচরের এই আশ্রয়ণে সাময়িক সমস্যা রয়েছে। বন্যা বা জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় পুরো এলাকা। যেহেতু আশ্রয়ণ প্রকল্পটি নদীর পাশে বাস্তবায়ন করা হয়েছে এজন্য এমন অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছে। জোয়ার আসলে আশ্রয়ণে কেউ বসবাস করতে পারেন না। এজন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রতিটি ঘরের দরজায় অল্প উচ্চতায় দেয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন পানি ওঠে না।

উপকারভোগী বারেক হাওলাদার বলেন, জোয়ারের সময় পানি আসে আবার ভাটার সময় পানি নেমে যায়। এই পানি ঠেকাতে দরজার সামনে দেয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে। আমাদের মূল সমস্যা পানি ঠেকানো। পানি না ঠেকাতে পারলে ঘর ভেঙে মানুষ মারা যেতে পারে।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন মাসুদ বলেন, গত ১২ আগস্ট বাহেরচর পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক স্যার। তিনি বাসিন্দাদের কাছ থেকে তাদের সমস্যার কথা শুনেছেন এবং দ্রুত সমাধানের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন।

শাহাদাত হোসেন মাসুদ বলেন, টেকনিক্যাল কমিটির সিদ্ধান্ত পেলেই জেলা প্রশাসক স্যার মন্ত্রণালয়ে ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের উন্নয়নে সুপারিশপত্র পাঠাবেন। আপনারা জানেন শ্রীপুরের ভৌগলিক অবস্থান বিচিত্র। ভাঙনপ্রবণ এলাকা এটি।

বাসিন্দারা কেউ স্থায়ীভাবে ঘরে থাকতে পারছেন না কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পানি ঢুকে পড়ে ঘরের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে। তখন হয়তো ঘর ভেঙে পড়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এজন্য বাসিন্দারা সব সময় থাকেন না। তবে চারদিকে গাইড ওয়াল করা হয়ে গেলে পানি প্রতিহত হবে। তখন আর এসব ঝুঁকি থাকবে না।

বাহেরচর পরিদর্শন করে জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাহেরচরের ঘর নিয়ে একটি টেকনিক্যাল কমিটির রিপোর্টের অপেক্ষায় আমরা আছি। রিপোর্টটি পেলে আমরা এখানে পানি যেন না ওঠে তার একটি যৌক্তিক সমাধান বের করবো। বাসিন্দারা যেসব সমস্যার কথা বলেছেন তা সমাধান করা হবে। 

জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার বলেন, বর্ষা মৌসুমে কাজ করলে তা সুফল বয়ে আনবে না। এজন্য আমরা একটু অপেক্ষা করছি। বর্ষা শেষ হলে এবং পানি নেমে গেলে কাজটি করলে সুন্দর এবং মজবুত হবে। বাজেট পাওয়ার পরপরই এখানে নতুন করে আবার কাজ শুরু করা হবে।

তিনি আরও বলেন, পুরো আশ্রয়ণ প্রকল্পটি ঢালাই করে দেওয়া হবে। ঘরগুলোর বারান্দা উঁচু করা হবে। ঘরের চারদিকে গাইডওয়াল করে দিব। এরপর আশা করি এমন কোনো সমস্যা আর থাকবে না।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর