প্রায় পাঁচ যুগেরও বেশি সময় ধরে কয়েক হাজার অবহেলিত মানুষ চলাচল করছিল একটি গ্রামীণ কাঁচা রাস্তা দিয়ে। যাদের বৃষ্টিতে জুতা হাতে নিয়ে, কাদা মাড়িয়ে আর বন্যায় কোমরপানি বা নৌকাই ছিল ভরসা। সরকার বদলেছে, স্থানীয় প্রতিনিধি বদলেছেন। আশ্বাসের পর আশ্বাসে নষ্ট হয়েছিল বিশ্বাস। তবু মনে ছিল উন্নয়নের জোয়ারে তারাও একদিন ভাসবে।

দীর্ঘ প্রতিক্ষার পরে ভাগ্য খোলে এলাকাবাসীর। সরকার তাদের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছে। সবার মনে আনন্দের জোয়র বইছে। নিজেদে এখন উন্নয়নের কাতারে ভাবতে ভালো লাগছে। কিন্তু সই আশার গুড়ে বালি পড়ল। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু অসাধু কর্মকর্তা আর ঠিকাদারের দুর্নীতিতে মাত্র ১৫ দিনেই ভেস্তে গেছে সব স্বপ্ন।

এদিকে সড়ক ভেঙে পড়ার পরও দায় নিচ্ছে না স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে অনিয়মের কারণে কিছুদিন কাজ বন্ধ রাখা হয়েছিল বল দাবি করেন উপজেলা প্রকৌশলী। এমনকি কিছু কাজ না করেই পুরো বিল তুলে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তন্ময় এন্টারপ্রাইজ। তবে বিল তুলে নেওয়ায় রাস্তাটি আর মেরামত হবে কি না, এটা নিয়েও স্থানীয়দের মনে দেখা দিয়েছে সংশয়।

সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মাগুড়া বিনোদ ইউনিয়নের তাড়াশ-নওগা সড়কের ঘরগ্রাম পূর্বপাড়ার সংযোগ সড়ক জলিলনগর মোড় হতে নাজিরের বাড়ি পর্যন্ত ৮০ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে সদ্য নির্মিত একটি সড়কের এমনই বেহাল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সরেজমিনে রাস্তাটি দেখতে গেলে অভিযোগ ও হতাশা প্রকাশ করেন এলাকাবাসী।

অভিযোগ করে স্থানীয়রা জানান, নানা সময়ে নানা জায়গায় ধরনা দিয়ে অবশেষে মেলে সেই বহুপ্রতীক্ষিত রাস্তাটি। কিন্তু সেটাও যেন ভাগ্যে সইছে না তাদের। নির্মাণ শেষ হতে না হতেই ১৫ দিনের মধ্যেই ধসে গেছে নতুন সড়ক। এখন যেন আরও কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে সড়কটি। কারণ পাকাকরণের আগে রাস্তা দিয়ে মোটামুটি সবই চলত। এখন পাকাকরণের পর রাস্তা ভেঙে পড়ায় বন্ধ হয় চলাচল। এখন হাঁটা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
  
স্থানীয় অসংখ্য মানুষ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের জীবনটাই কেটে গেল একটা রাস্তার আশায়। তবু অসংখ্য জায়গায় ধরনা দিয়ে মেলে রাস্তাটির অনুমোদন। এরপর রাস্তার কাজ শুরু হওয়ার পরেই নিম্নিমানের কাজের অভিযোগ ওঠে। এ কারণে দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ থাকার পরে খুব দ্রুত সময়ে তড়িঘড়ি করে কাজ শেষ করেন ঠিকাদার। এ সুযোগে কোনো রকমে রাস্তার কাজ শেষ করে যান ঠিকাদার। কিন্তু ১৫ দিনের মধ্যেই কয়েক জায়গায় ভেঙে পড়ে রাস্তাটি।

এর মধ্যে এক জায়গায় প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ মিটার রাস্তা ভেঙে পুকুরে পড়ে গেছে। সেখান দিয়ে রাস্তা কাঁচা থাকা অবস্থায় ভ্যান ও অটোগাড়ি চলাচল করলেও এখন সাইকেল চলতেও কষ্ট হয়। মানুষজন অসুস্থ হলেও ঘাড়ে করে নিয়ে আসা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তাহলে এই রাস্তা দিয়ে কি আমাদের দুর্ভোগ ছাড়া শান্তি হবে না?

তাড়াশ উপজেলা প্রকৌশলী অফিস সূত্রে জানা যায়, ৮৫ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় ধরে ১ হাজার ১৫০ মিটার রাস্তাটির কাজ পায় তন্ময় এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ৫০ মিটার বাদ দিয়ে ১ হাজার ১০০ মিটার রাস্তার কাজ করে তন্ময় এন্টারপ্রাইজ। তখন এলজিইডি বাকি ৫০ মিটার রাস্তা বাদ দিয়ে বিল দেয়। এতে অল্প রাস্তা থেকেই গ্রামবাসীর হারাতে হয় আরও ৫০ মিটার রাস্তা।

আরও জানা যায়, গত বছরের ১৫ মে কাজ শুরু হয়ে চলতি বছরের ৩০ জুলাই শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত বছরের শেষের দিকে কাজ শুরু করে তড়িঘড়ি ও নিম্নমানের কাজ করে চলতি বছরের ৩০ জুলাই তা শেষ করে। এমনকি সড়ক হস্তান্তরের দিনই উত্তোলন করে নেওয়া হয় শতভাগ বিলও।
 
এর ১৫ দিন যেতে না যেতেই প্রায় ৫০ মিটার রাস্তার সিংহভাগ ধসে পড়ে যায়। এমনকি সেই স্থলে গাইডওয়াল দেওয়ার কথা থাকলেও সেখানে নামমাত্র কিছু খুঁটি দেওয়া হয়েছিল। এখন বৃষ্টি ও পানি চলে আসায় সেই জায়গাটির আর সংস্কারও করতে পারছেন না ঠিকাদার ও কর্তৃপক্ষ। ফলে তাদের এই অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি আরও বেশি প্রকাশ্যে চলে আসে।

গ্রামবাসী বলছেন, সড়কটির দায়িত্বরত উপজেলা উপসহকারী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তন্ময় এন্টারপ্রাইজের ঠিকাদারের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সরকারি বা জনগণের টাকার যথাযথ ব্যবহার হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের রাস্তাটির দায়িত্বরত উপসহকারী প্রকৌশলী (এসডি) মো. আনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাস্তাটির কাজের মান নিয়ে সমস্যা নেই কিন্তু নতুন রাস্তা জন্য ভেঙে পড়েছে।

গাইডওয়ালের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে ৪০ মিটার গাইডওয়াল না দিয়ে প্যালাসাইটিং করা হয়েছে। কিন্তু সেটাও নেই বললে তিনি আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে বর্ষা শেষ হলে আবার কাজ করে দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। এই কাজে অনিয়ম, নিম্নমানের কাজ ও দুর্নীতি হয়েছে জানতে চাইলে এ ব্যাপারে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
 
তাড়াশ উপজেলা প্রকৌশলী মো. আবু সাঈদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাস্তাটিতে নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে ও কাজে কিছু অনিয়ম হওয়ায় আমরা মাঝখানে কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে আবার কাজ শেষ করা হয়েছে। তবে ধসে পড়া জায়গা বর্ষা শেষে মেরামত করে দেওয়া হবে জানিয়ে গাইডওয়ালের ব্যাপারে বলেন, সেখানে নিয়ম অনুযায়ী গাইডওয়াল দেওয়া হয়েছে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তন্ময় এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী এম এ আল বাকি ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেহেতু বর্ষার মৌসুম তাই রাস্তাটি ধসে গেছে। আমার জামানত এখনো আছে। তাই বর্ষার পরে আমি রাস্তাটি আবার সংস্কার করে দেব। নিম্নমানের কাজের বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলতে চাননি।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সিরাজগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি আমি জানি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তন্ময় এন্টারপ্রাইজকে এ বিষয়ে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। যেহেতু এখন মাটি পাওয়া যাচ্ছে না, তাই বর্ষার পরে রাস্তাটি আবার করে দেওয়া হবে।

শুভ কুমার ঘোষ/এনএ