লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের শৌলমারীতে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জোর করে দখলে নেওয়া আবাদি জমি ‘জায়েজ’ করতে এবার জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইন্ট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির সীমানার কাঁটাতারের ভেতরে থাকা এক ব্যক্তির ৩ একর ৬৪ শতাংশ জমি জাল দলিলের মাধ্যমে রেজিস্ট্রি করে নেওয়া হয়েছে গত ২৯ আগস্ট।

জানা যায়, জমিটির মূল মালিক মকলেছার রহমান মারা গেছেন প্রায় ১৭ বছর আগে। অথচ তাকেই ‘জীবিত’ দেখিয়ে মোখলেছার রহমান নামের এক ব্যক্তিকে মকলেছার রহমান বানিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য জমি কেনা ও দেখভালের দায়িত্বে থাকা একটি চক্র।

মৃত মকলেছার রহমান কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তার বাবার নাম ইয়ার আলী। অন্যদিকে মালিক সেজে জমি লিখে দেওয়া মোখলেছার রহমান একই উপজেলার তুষভান্ডার ইউনিয়নের কাশিরাম গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবার নাম ইয়ার উদ্দিন।

ইতোমধ্যে জমি জালিয়াতির বেশ কিছু নথি ঢাকা পোস্টের হাতে এসেছে। বিষয়টি চাপা দিতে নানা তদবির শুরু করেছেন সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রার, দলিল লেখকসহ সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংশ্লিষ্টরা। তবে এ ঘটনায় আইনের আশ্রয় নেবেন বলে জানিয়েছেন জমির মূল মালিকের বর্তমান ওয়ারিশরা।

জমির ভুয়া মালিক ও বর্তমান জমিদাতা মোখলেছার রহমান

তারা অভিযোগ করে জানান, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে স্থানীয় ভূমি অফিস, দলিল লেখক ও সাব-রেজিস্ট্রারের যোগসাজশে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে।

জালিয়াতির মাধ্যমে বিক্রি করা জমির অবিকল নকলে দেখা যায়, তুষভান্ডার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের গত ২৯ আগস্টের ৪৩৩৮/২১ নম্বর দলিলে এ জালিয়াতি হয়েছে। ৩ একর ৬৪ শতাংশ জমির মূল্য দেখানো হয়েছে ৫৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। জমিদাতা ‘মো. মোখলেছার রহমান ওরফে মকলেছার রহমান, পিতা ইয়ার উদ্দিন ওরফে ইয়ার আলী’। জমিদাতার স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে উপজেলার ভোটমারী ইউনিয়নের ভোটমারী গ্রাম উল্লেখ করা হয়েছে (প্রকৃত ঠিকানা তুষভান্ডার ইউনিয়নের কাশিরাম গ্রামে)। ১৩৪৪ খতিয়ান ও ১০ হাজার ২৯৯ দাগের ভোটমারী মৌজার জমিটি রেজিস্ট্রি করা হয় ইন্ট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেডের পক্ষে পরিচালক সাখাওয়াত হোসেনের নামে। দলিল লেখক আলমগীর হোসেন দলিলটি সম্পাদন করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জমিটি তুষভান্ডার সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে রেজিস্ট্রি করা হয়নি। বিষয়টি গোপন রাখতে পাশের উপজেলা হাতীবান্ধার পূর্ব বিছনদই গ্রামের ইব্রাহিম আলীর ছেলে রবিউল আলম বাবুর বাড়িতে কমিশন দলিল করা হয়েছে। ওই বাড়িতে গিয়ে সাব-রেজিস্ট্রার রতন অধিকারী গত ২৯ আগস্ট দলিল রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করেন। ওই বাড়িতে কাশিরাম থেকে মোখলেছার রহমানকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দলিলে সাক্ষী হিসেবে রবিউল আলম বাবুর স্বাক্ষরও রয়েছে। সেখানে শনাক্তকারী ছিলেন কালীগঞ্জের শৌলমারী গ্রামের আব্দুস সাত্তারের ছেলে বুলু মিয়া।

মূল মালিকের নামে জমির পর্চা

আরও জানা গেছে, হাতীবান্ধা উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রবিউল আলম বাবু। সম্পন্ন দলিলের সাক্ষী এই বাবু ও শনাক্তকারী বুলু দুজনেই ইন্ট্রাকো সোলার পাওয়ারের জমি কেনা, দখলসহ নানা কর্মকাণ্ডে জড়িত।

অনুসন্ধানে জানা যায়, জমি লিখে দেওয়া ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নাম মো. মোখলেছার রহমান, পিতা ইয়ার উদ্দিন ও মা আমেনা খাতুন বলে উল্লেখ রয়েছে। ঠিকানা হিসেবে কাশিরাম গ্রামের উল্লেখ রয়েছে।

বিষয়টি জানতে ভোটমারী ইউনিয়ন পরিষদে যান এই প্রতিবেদক। সেখানে দেখা যায়, পরিষদের চেয়ারম্যান আহাদুল হোসেন চৌধুরী স্বাক্ষরিত মৃত্যুসনদে উল্লেখ করা হয়েছে, ভোটমারী গ্রামের ইয়ার আলী ছেলে মকলেছার রহমান ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন। তার মায়ের নাম ছুরতন নেছা। মকলেছার রহমান ওই ইউনিয়নের স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন বলেও চেয়ারম্যান ওই সনদে উল্লেখ করেছেন। ওয়ারিশ সনদেও মকলেছার রহমান স্ত্রী, তিন মেয়ে ও দুই ছেলে রেখে মারা গেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

ঘটনার এখানেই শেষ নয়, চক্রটি খুব চতুরতার সঙ্গে একটি জাল সনদে মৃত মকলেছার রহমানকে জীবিত মোখলেছার হিসেবে দেখিয়ে খাজনা প্রদানসহ জমিটি রেজিস্ট্রি করে। আবার মোখলেছার ও মৃত মকলেছার একই ব্যক্তি, এটি প্রমাণ করতে চক্রটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের একটি জাল সনদের আশ্রয় নেয়। সেখানে তার নাম লেখা হয় মোখলেছার রহমান ওরফে মকলেছার রহমান ও বাবার নাম উল্লেখ করা হয় ইয়ার উদ্দিন ওরফে ইয়ার আলী। সনদপত্রে ওই ব্যক্তির বর্তমান ঠিকানা তুষভান্ডারের কাশিরাম ও স্থায়ী ঠিকানা ভোটমারী ইউনিয়নের ভোটমারী গ্রাম দেখানো হয়। এতে বলা হয়, বিআরএস খতিয়ানে উল্লেখিত মকলেছার ও জাতীয় পরিচয়পত্রের মোখলেছার একই ব্যক্তি।

জমির মূল মালিক মকলেছার রহমানের মুত্যু সনদ

এ বিষয়ে ভোটমারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আহাদুল হোসেন চৌধুরী বলেন, ওই সনদ আমি দিইনি। আমার সই স্ক্যান করে সেটি বানানো হয়েছে। মৃত মকলেছার রহমানকে আমি চিনতাম। তিনি ইউপি সদস্য ছিলেন।

শুধু সনদ জালিয়াতিই নয়, রেজিস্ট্রির আগে খাজনা পরিষদে নেওয়া হয়েছে কৌশলের আশ্রয়। অভিযোগ আছে, ভোটমারী ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন ঘুষের বিনিময়ে মোখলেছার রহমানের নামে ওই খতিয়ান-দাগের বিপরীতে গত ৩০ জুন ১৪২৫ থেকে ১৪২৮ বাংলা সালের জন্য ৩ হাজার ৯৬২ টাকা ভূমি উন্নয়ন কর গ্রহণ করেছেন। যদিও ভোটমারী মৌজার ১৩৪৪ খতিয়ানের পর্চায় ১০২৯৯ দাগের ৩ একর ৬৪ শতাংশ জমির মালিক হিসেবে রয়েছেন ইয়ার আলীর ছেলে মকলেছার রহমান।

এদিকে জাল দলিলের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর প্রকৃত মালিকের ওয়ারিশরা ওই অফিসে গত ১ সেপ্টেম্বর ১৩৯৪ থেকে ১৪২৮ বাংলা সালের জন্য ৩৭ হাজার ৫৩৮ টাকা এবং ১৪২৯ সালের জন্য ৭২৮ টাকা ভূমি উন্নয়ন  কর বা খাজনা জমা দিয়ে রশিদ গ্রহণ করেন।

কথা হয় জমিদাতা হিসেবে অভিযুক্ত মোখলেছার রহমানের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টের কাছে স্বীকার করে বলেন, জমির মালিক সাজাতে আমার পেছনে অনেক দিন ধরে ঘুরেছে কয়েকজন। জমি লিখে দিলে আমাকে টাকা দেওয়ার কথা জানিয়েছিল। রাজি হলে বাবুর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আমার সই নেওয়া হয় দলিলে।

মৃত মকলেছারকে মোখলেছার বানাতে জাল প্রত্যয়নপত্র

কিন্তু কতটুকু জমি বা কত টাকায় বিক্রি হয়েছে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সেটা আমাকে জানানো হয়নি। আমাকে এক লাখ টাকাও দেয়নি।

জমিটির প্রকৃত মালিকের ছেলে আরিফুজ্জামান বিপ্লব বলেন, আমার বাবা হয়তো অনেক কষ্ট করে জমিটি কিনেছিলেন। কিন্তু আমাদের দুই ভাইয়ের ঢাকায় থাকার সুযোগে প্রথমে জমিটি দখল করা হয়েছে। এরপর জাল দলিলের মাধ্যমে তা বিক্রি করা হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে আইনের আশ্রয় নেব।

দলিল লেখক আলমগীর হোসেন সব কাগজপত্র ঠিকঠাক আছে এবং মূল মালিকই তা বিক্রি করেছেন দাবি করে বলেন, এরপরও মূল মালিক বা তার অংশীদাররা যদি জমিটি রেজিস্ট্রি না করে দিয়ে থাকেন, তবে তা রেজিস্ট্রিই হয়নি।

তুষভান্ডারের সাব-রেজিস্ট্রার রতন অধিকারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, জমিদাতার নামের সামান্য তারতম্য আছে। তবে এটা কোনো বিষয় না। এরপরও যদি দলিল লেখক তথ্য গোপন করে থাকেন, তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জমিদাতা অসুস্থ, সে জন্য বাড়িতে গিয়ে কমিশন দলিল করতে হবে, তাকে এমন তথ্য জানিয়ে নেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করেন এই কর্মকর্তা।

প্যারামাউন্ট বিট্র্যাক এনার্জি লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) আব্দুল হালিম মুঠোফোনে বলেন, মৃত ব্যক্তির জমি কেনার কোনো মানে হয় না। আমরা জীবত ব্যক্তির জমি কিনেছি। যদি কেউ বলে থাকে তাহলে তিনি মিথ্যা বলছেন। এই কথা বলেই তিনি ফোনের লাইন কেটে দেন।

এনএ