বসকে ঘুষ দিয়েও চাকরি হয়নি ছেলের, হতাশায় আত্মহত্যা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সন্তানকে ব্যাংকার বানাবেন, এমন স্বপ্নে বিভোর ছিলেন বাবা এমদাদুল হক। তাই ঊর্ধ্বতন বসের প্রলোভনে পড়ে দুই দফায় ১০ লাখ টাকা তুলে দেন বসের হাতে। কিন্তু এত টাকা হাতে তুলে দেওয়ার তিন বছর পরও যখন চাকরি হয়নি, টাকাও পাননি, তখন ভেঙে পড়েন। এদিকে ঋণ করা টাকার সুদ ও পরিশোধ বিষয়টা তাকে পীড়া দিতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে হতাশা ও ক্ষোভের মুখে এমদাদুল হক বেছে নেন আত্মোৎসর্গের পথ।
তার আগে একটি চিরকুটে লিখে গেলেন আত্মোৎসর্গের কারণ। যেখানে উঠে এসেছে বাজিতপুর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনার সাবেক কর্মকর্তা মো. সারওয়ার জাহানের কাছে এমনভাবে প্রতারিত হওয়ার কাহিনি।
বিজ্ঞাপন
কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলার হালিমপুর উইনিয়নের পাঁচআনি গ্রামে এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটেছে। এমদাদুল হক এ গ্রামেরই বাসিন্দা। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে আত্মহত্যা প্ররোচনার অভিযোগে থানায় একটি মামলা করা হয়। তবে পুলিশ বলছে, মামলাটির গুরুত্ব বিবেচনায় মামলাটি ইতোমধ্যে রেঞ্জ মনিটরিং সেল থেকে নিবিড়ভাবে তদারকি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
অভিযুক্ত সারওয়ার জাহান জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার মেরুরচর ইউনিয়নের টুপকারচর পুরান গ্রামের মো. হজরত আলীর ছেলে। বর্তমানে তিনি চাকরিতে থেকে পিআরএল ভোগ করছেন।
বিজ্ঞাপন
সূত্রে জানা গেছে, এমদাদুল হক পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের একজন ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক ছিলেন। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে চাকরি থেকে অবসর নেন তিনি। তবে চাকরিরত অবস্থায় বাজিতপুর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনার সাবেক কর্মকর্তা মো. সারওয়ার জাহানের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। দুজনের আলাপচারিতায় একদিন এমদাদুল হক তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলের চাকরির কথা তুলতেই সারওয়ার জাহান বলেন, ১০ লাখ টাকার ব্যবস্থা করতে পারলে ব্যাংকে চাকরির ব্যবস্থা করা যাবে।
ছেলেকে ব্যাংকে চাকরি দেওয়ার প্রলোভনে প্রলুব্ধ হয়ে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে পাঁচ লাখ এবং একই বছরের অক্টোবর মাসে আরও পাঁচ লাখ টাকাসহ মোট ১০ লাখ টাকা তুলে দেন সারওয়ার জাহানের হাতে। টাকা দেওয়ার তিন বছর পেরিয়ে গেলেও চাকরি হয়নি ছেলের।
এই তিন বছরে চাকরি না হওয়া ও ১০ লাখ টাকার এক টাকাও ফেরত না পাওয়ায় চরমভাবে হতাশা হয়ে পড়েন এমদাদুল হক। এদিকে মানুষের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের সুদ ও পাওনা পরিশোধ না করার উপায়ান্তর না পেয়ে এমদাদুল হক বেছে নিলেন আত্মোৎসর্গের পথ। এমন তথ্যই মৃত্যুর আগে লিখে যান পাঁচ পৃষ্ঠার চিরকুটে।
এমদাদুল হকের পরিবারের অভিযোগ, বাজিতপুর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. সারওয়ার জাহান টাকা ফেরত না দেওয়ায় ঋণের চাপে গত মাসের ১৯ আগস্ট সন্ধ্যায় নিজ বাড়িতে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন এমদাদুল হক। পরে লাশ ময়নাতদন্ত করে দাফনের পর আত্মহত্যার আগে লিখে রেখে যাওয়া চিরকুটের ওপর ভিত্তি করে ২১ আগস্ট নিহতের ছেলে মোহাম্মদ রাজীবুল হক বাদী হয়ে বাজিতপুর থানায় একটি আত্মহত্যা প্ররোচনায় মামলা করেন।
এলাকাবাসী কাসেম আলী জানান, সন্ধ্যার দিকে এমদাদুলের আত্মহত্যার খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে গ্রামের হাজার হাজার লোক বাড়িতে এসে ভিড় করে। পরে পুলিশ এসে ফাঁসরত অবস্থায় এমদাদুলের মরদেহ উদ্ধার করে। এ সময় তার পকেটে একটি চিরকুট পাওয়া যায়। যেখানে তিনি আত্মহত্যার কারণ লিখে গেছেন। এমদাদুল হক খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তবে ছেলের চাকরির জন্য তার বসকে টাকা দিয়ে চাকরি ও টাকা ফেরত না পাওয়ার হতাশায় তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
এ বিষয়ে এমদাদুল হকের ছেলে মো. রাজীবুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাবার স্বপ্নপূরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল থেকে উন্নয়ন ও অধ্যয়ন বিভাগ থেকে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করি। পড়ালেখা শেষ করার পরও দীর্ঘদিন ধরে আমার চাকরি হচ্ছিল না। এ হতাশা থেকে আমার বাবা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. সারওয়ার জাহানকে গোপনে টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু চাকরি ও টাকা না পাওয়ায় বাবা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। আমার বাবার এই হত্যার জন্য একমাত্র সারওয়ার জাহানই দায়ী।
তিনি আরও বলেন, সারওয়ার জাহানের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণসহ টাকা ফেরত এবং তার ফাঁসির দাবি জানাই। একই সঙ্গে আমার অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
আমার বাবা আত্মহত্যার আগে লিখে যাওয়া চিরকুট থেকে জানা গেছে, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে পাঁচ লাখ এবং একই বছরের অক্টোবর মাসে আরও পাঁচ লাখ টাকাসহ মোট ১০ লাখ টাকা তুলে দেন সারওয়ার জাহানের হাতে।
এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য মো. সারওয়ার জাহানের মোবাইল ফোনে বারবার কল করেও যোগাযোগ করা যায়নি। তবে একটি সূত্রে জানা গেছে, মো. সারওয়ার জাহান এ মামলায় হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নিয়েছেন।
বাজিতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাজহারুল ইসলাম মৃত্যুর আগে চিরকুট লিখে যাওয়ার বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, এ ঘটনায় এমদাদুল হকের ছেলে মোহাম্মদ রাজীবুল হক বাদী হয়ে বাজিতপুর থানায় একটি আত্মহত্যা প্ররোচনার মামলা করেছেন। মামলাটির গুরুত্ব বিবেচনায় ইতোমধ্যে রেঞ্জ মনিটরিং সেল থেকে নিবিড়ভাবে তদারক করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এনএ