ছোট থেকেই শহিদুল (৩৫) মানসিক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। এলাকার লোকজনকে মারধর ও বাড়ির জিনিসপত্র ভাঙায় তার পায়ে পরানো হয় লোহার বেড়ি। মানসিক যন্ত্রণা শুরু হলে শরীরে কামড় ও খামচিয়ে রক্তাক্ত করেন। অভাব-অনটনের কারণে তার চিকিৎসাও করাতে পারছে না। আর এভাবেই ১৭ বছর ধরে বেড়ি পরে ঘুরছেন শহিদুল। 

শহিদুল টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার কাকড়াজান ইউনিয়নের মহানন্দনপুর গ্রামের মৃত আজিম উদ্দিন ও কাজল রেখার ছেলে।

সরেজমিনে মহানন্দনপুর গ্রামে দেখা গেছে, শহিদুল বাড়ির আঙিনায় পায়ে শিকল পরে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। লোহার শিকল পরতে পরতে কালো হয়ে গেছে তার পায়ের গোড়ালি। তার হাত ও শরীরে কামড়-খামচানোর চিহ্ন স্পষ্ট। শহিদুল যে টিনের ঘরটিতে থাকে সেটিও ভেঙে গেছে।

জানা গেছে, উপজেলার মহানন্দনপুর গ্রামের শহিদুল ছোট থেকেই প্রতিবন্ধী। তার তিন ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। আরেক ভাই আলাদা সংসার করেছে। সেই ভাইয়ের সংসারেও অভাব। পাঁচ বছর আগে ছেলের ওষুধ আনতে গিয়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাবা আজিম উদ্দিন মারা যায়। এরপর থেকেই ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছে না শহিদুলের। বর্তমানে শহিদুল তার বৃদ্ধ মায়ের সঙ্গে থাকে। পায়ে লোহার বেড়ি পড়ে স্থানীয় বাজারে গিয়ে ভিক্ষা করেন। সেই টাকা তুলে দেন মায়ের হাতে। স্থানীয়রাও তাকে সহযোগিতা এবং আদর করেন। 

আত্মীয়-স্বজন ও স্থানীয়রা মিলে টাকা তুলে শহিদুলকে পাবনার মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করানোর জন্য নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানকার কর্মরতরা শহিদুলকে দেখে এবং তার সঙ্গে কথা বলে তাকে সেখানে ভর্তি করেননি। পরে শহিদুলকে এলাকায় নিয়ে আসা হয়। এলাকার পল্লী চিকিৎসক দেখিয়ে ওষুধপত্র খাওয়ানো হয়। কিছু দিন ভালো থাকলেও আবার তিনি পাগলামি শুরু করেন।

শহিদুলের চাচাতো ভাই আরিফুল ইসলাম বলেন, শহিদুল বাড়ির বাইরে গেলে, তাকে কেউ কিছু বললে তাদের মারধর করতে যায়। এ ছাড়া হঠাৎ করে গ্রামের শিশুদের গলা ধরে আছাড় মারে। যেন দুর্ঘটনা না ঘটে সেজন্য তার পায়ে লোহার বেড়ি পরানো হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, শহিদুলের পরিবারে চিকিৎসা করানোর মতো কেউ নেই। তার প্রতিবন্ধী ভাতা ও তার মায়ের বিধবা ভাতার টাকায় তাদের সংসার চলে।

শহিদুলের চাচা বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম বলেন, ছোটবেলা থেকেই শহিদুলের মাথায় সমস্যা ছিল। সে ঠিকমতো কথাও বলতে পারে না। তার উন্নত চিকিৎসা হলে সে সুস্থ জীবন ফিরে পাবে। কিন্তু চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্য নেই তার পরিবারের। বাবা হারানো শহিদুলের চিকিৎসার জন্য তিনি সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন।

মহানন্দনপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা বলেন, প্রতিবন্ধী শহিদুলের জন্য ওষুধ আনতে গিয়ে তার বাবা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তার মা বৃদ্ধ। দুইজনের ভাতার টাকায় যেখানে সংসার চালানো দায় সেখানে চিকিৎসা করবে কীভাবে? কে চায় নিজের সন্তানের পায়ে শিকল বেঁধে রাখরত? উন্নত চিকিৎসা করা হলে অন্য দশজনের মতো তার জীবনও সুন্দর হবে।

কাকড়াজান ইউনিয়নের সাবেক নারী ইউপি সদস্য ও শহিদুলের বোন সায়েমা আক্তার রেখা জানান, শহিদুলের ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তার বাবা এবং আমার ছেলে ওষুধ আনতে গিয়েছিল। ওষুধ নিয়ে ফেরার সময় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুজনই মারা গেছেন। এই শোক সহ্য হয় না। তার পরিবার খুবই অসহায়। শহিদুলের থাকার মতো কোনো ঘরও নেই। ভাঙা-চোরা একটা ঘরে থাকে শহিদুল। 

মহানন্দনপুর গ্রামের স্বেচ্ছাসেবক আলমগীর হোসেন বলেন, শহিদুলের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তিন বেলা খাবার জোটে না তাদের। গ্রামের লোকজন মিলে টাকা তুলে শহিদুলের চিকিৎসার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পাবনায় তাকে ভর্তি করেনি। দিন দিন তার শারীরিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে। 

শহিদুলের মা কাজল রেখা বেওয়া বলেন, ছেলেটাকে নিয়ে খুবই কষ্টে আছি। ঘর ও জিনিসপত্র ভেঙে চুরমার করে। রাস্তায় তাকে কেউ পাগল বললে তাদের মারধর করে। শহিদুলের ওষুধ আনতে গিয়ে দুর্ঘটনায় ওর বাবা মারা যায়। সংসারে উপার্জনক্ষম কেউ নেই এখন।তবে গ্রামের অনেক মানুষ শহিদুলকে সাহায্য করে।

কাকড়াজান ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নং ওয়ার্ডের সদস্য জয়নাল আবেদীন বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শহিদুল ও তার মায়ের ভাতা কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। এই টাকা দিয়ে তার সংসার চলে না। শহিদুলের উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। তার চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রশাসনের দৃষ্টি কামনা করছি। উন্নত চিকিৎসা হলে সুস্থ জীবন ফিরে পাবে শহিদুল।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চিত্রা শিকারী বলেন, মানসিক প্রতিবন্ধী শহিদুলকে চিকিৎসা করালে ভালো হবে কি না সেটার বিষয়ে জেনে এবং সরকারি অন্যান্য সুযোগ সুবিধা যাতে ওই পরিবার পায় তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসপি