করোনার আঘাতে সারাদেশে বন্ধ হয়ে পড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেই বন্ধের সময় সব বয়সের শিক্ষার্থীরা আটকে পড়ে বাসায়। কেউ পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ালেও এমন সুযোগ হয়ে ওঠেনি কলেজ শিক্ষার্থী আফরিন সুলতানার। কারণ, অভাবের সংসারে নানা চাহিদা উঁকি দিলেও পূরণ হয় না সহজে।

তাই হতাশ হয়ে ঘরে বসে থাকেননি সুলতানা। মায়ের সঙ্গে মোড়া বানিয়ে দেড় বছর সময় পার করছেন তিনি। এতে অর্থ উপার্জন করে কাজে লাগিয়েছেন সময়টা। অভাবের সংসারে মা-বাবাকে দিয়েছেন কিছুটা স্বস্তি।

মাটিরাঙ্গা পৌরসভার কাজীপাড়া এলাকায় বসবাস করেন তিনি। তার বাবা পেশায় একজন ফার্নিচারশ্রমিক। পরিবারে তারা দুই বোন। বয়সে তিনি ছোট। মাটিরাঙ্গা মহিলা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন তিনি। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় মহামারি করোনাভাইরাস। আর এই পুরো সময়টা কাজে লাগিয়েছেন তিনি।

এদিকে করোনার আঘাতে দিনমজুর বাবা কাজ হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন। কিন্তু সেই হতাশার সময়টায় মেয়ে মোড়া বানিয়ে সংসারের হাল ধরায় পরিবারে দূর হয়েছে অভাব।

জানা গেছে, সুলতানা প্রতি মাসে ১০ থেকে ১৫টি মোড়া বানান। প্রতিটিতে খরচ হয় প্রায় ২০০ টাকা। প্রতি জোড়া ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি করেন। লভ্যাংশ দিয়ে চলে নিজের ও পরিবারের খরচ। গেল দেড় বছর মায়ের সঙ্গে অসংখ্য মোড়া বানিয়ে বিক্রি করে প্রচুর টাকা আয় করেন তিনি। এতে টানাটানির সংসারে অর্থসংকট কিছুটা হলেও কমেছে।

শিক্ষার্থী আফরিন সুলতানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার সময় কলেজ বন্ধ থাকায় আমি আমার বান্ধবীদের সঙ্গে সময় না কাটিয়ে ভিন্ন কিছু করতে চেয়েছি। তাই মায়ের সঙ্গে মোড়া বানানোতে সময় দিয়েছি। এতে আমি যে অর্থ উপার্জন করতে পেরেছি, তা আমার পরিবারের বাড়তি জোগান হয়েছে। এতে আমাদের অভাবের সংসারে কষ্ট লাঘব হয়েছে।

মোড়া বানানোর প্রশিক্ষণ কোথায় পেলেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছোট থেকেই দেখেছি অবসর সময়ে আমার মা-চাচিরা এই কাজ করে আসছেন। তাদের কাছ থেকে দেখেই আমি শিখেছি। আমি এখন খুব অল্প সময়ের মধ্যে মোড়া বানাতে পারি। প্রতি মাসে ১০ থেকে ১৫টি মোড়া উৎপাদন করতে পারি। তবে বেশি পুঁজি নেই আমার। যদি কোথাও থেকে ঋণ নেওয়ার ব্যবস্থা হয়, তাহলে আরও বেশি পরিমাণ মোড়া বানাতে পারব।

সুলতানার মা আকলিমা আক্তার বলেন, করোনায় কলেজ বন্ধ হওয়ার পর থেকে অন্য মেয়েরা যেখানে বিভিন্ন দিকে ঘুরে সময় পার করে, সেখানে আমার মেয়ে বাসায় বসে না থেকে আমার সঙ্গে সময় দিয়ে মোড়া বানিয়ে বিক্রি করছে। এতে যে টাকা আয় হয়েছে, তা দিয়ে তার পড়ালেখার খরচ চালিয়ে বাকি টাকা পরিবারকে দিয়েছে। যা দিয়ে পরিবারের বিভিন্ন কাজে লাগানো হয়েছে। এটা আমাদের মা-বাবার জন্য অনেক বড় পাওয়া।

তার বাবা মো. আরিফ হোসেন বলেন, দেশে মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকেই আমার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এতে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে আমাকে পরিবার নিয়ে। সংসার চালানোর পর মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালানো অসম্ভব। এই সময়টায় আমার মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে সময় দিয়ে মোড়া বানিয়ে বিক্রি করছে। মা-মেয়ের আয় দিয়েই সংসার চলছে। এই কাজ না করল হয়তো পরিবার চালানো সম্ভব হতো না।

গ্রামের নারীদের কাছ থেকে মোড়া কিনে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করা দিল মোহাম্মদ রিফন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি গ্রামের নারীদের কাছ থেকে বিভিন্ন সাইজের মোড়া কিনে কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলায় পাইকারি বিক্রি করে থাকি। এতে আমার যে লাভ হয়, তা দিয়ে পরিবার চলে। এই গ্রামের মানুষ গরিব হওয়ায় বেশি পরিমাণ পুঁজি দিয়ে মোড়া বানাতে পারে না। যদি তাদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে তারা আরও স্বাবলম্বী হতে পারবেন।

খাগড়াছড়ি জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নারীদের জন্য আমাদের অফিসে নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। সুলতানা চাইলে সেগুলো শিখতে পারে। এতে আরও নতুন কিছুতে অভিজ্ঞতা অর্জন হবে। এ ছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আমাদের এখান থেকে সামান্য ঋণ নেওয়ার সুযোগ আছে। যদি সে নিয়ম অনুসারে আবেদন করে, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব।

এনএ