প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মাদরাসা পড়ুয়া ছাত্রীরা বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে

করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় টাঙ্গাইলে শতাধিক ছাত্রী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। শহরের চেয়ে গ্রাম ও চরাঞ্চলে বাল্যবিবাহ বেশি হয়েছে। তবে বিয়ের পরও বহু ছাত্রী বিদ্যালয়ে আসছে পড়াশুনা করতে। জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খোজঁ নিয়ে এমন তথ্য জানা গেছে।

করোনাকালে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার চরাঞ্চলের হুগড়া হাবিব কাদের উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫০ জন ছাত্রী, কালিহাতীর ফিরোজ নগরের গান্ধিনা এলাকার ফেরদৌস আলম ফিরোজ উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪২ জন, ভূঞাপুর উপজেলার চরাঞ্চল গাবসারা ইউনিয়নের রায়ের বাসালিয়ার কুলসুম জামান উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৮ জন, চরগাবসারা দাখিল মাদরাসার ৩০ জন, টেপিবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৫ জন, গোবিন্দাসী উচ্চ বিদ্যালয়ের দুই শ্রেণির প্রায় ২৫ জন ছাত্রীসহ জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শত শত ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে। তবে এদের অনেকেই পড়াশোনায় নিয়মিত থাকলেও অধিকাংশ ছাত্রী অভাব-অনটন, বিয়ে হয়ে স্বামীর বাড়িতে অবস্থান ও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনিয়মিত রয়েছে। 

জানা গেছে, হুগড়া হাবিব কাদের উচ্চ বিদ্যালয়ে বর্তমান শিক্ষার্থী সংখ্যা ১ হাজার ৫৫৬ জন। এর মধ্যে এসএসসি পরীক্ষার্থী হিসেবে ফরম পূরণ করেছে ৩৫৯ জন। বিদ্যালয়ের সব শ্রেণি মিলিয়ে প্রায় ৫০ জন ছাত্রীর করোনাকালে বিয়ে হয়ে গেছে। কালিহাতী উপজেলার প্রত্যান্ত অঞ্চল ফিরোজ নগরের গান্ধিনা এলাকার ফেরদৌস আলম ফিরোজ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৪২ জন ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। এছাড়া জেলা-উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শতকরা ১০ থেকে ২৫ ভাগ ছাত্রী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে।

শিক্ষকরা জানিয়েছেন, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিল। এর মধ্যে ভালো ছেলে পেয়ে অনেকেই তাদের মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। বিষয়টি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়নি। বিয়ে ভেঙে যাওয়ার ভয়ে তারা শিক্ষকদের কিছু জানায়নি। তবে বাল্যবিবাহের শিকার অনেক শিক্ষার্থীই বিদ্যালয়ে নিয়মিত অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়েছে এবং পড়াশোনা করছে। বাল্যবিবাহ বন্ধে প্রশাসনের জোড়ালো পদক্ষেপ এবং এর কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে পারলে বাল্যবিবাহের সংখ্যা কমে আসবে।

ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী জেসমিন জানায়, বাবা-না থাকায় এবং পারিবারিক আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। কর্মজীবী এক ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। 

একই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী লাবণী সরকার বলে, পরিবারের ইচ্ছার কারণেই আমাকে বিয়ে করতে হয়েছে। তারপরও পড়াশোনা বন্ধ করিনি। নিয়মিত বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করছি।

ভূঞাপুর উপজেলার গাবসারা ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার ইয়াদ আলী কাজী বলেন, করোনার কারণে একদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, অন্যদিকে চরাঞ্চলে দারিদ্রের কারণে বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেশি। এতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মাদরাসা পড়ুয়া ছাত্রীরা বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। গ্রামের ইমাম এই বিয়ে পড়ান। এতে মেয়ের বয়স কম হওয়ায় কাজিদের কাছে অভিভাবকরা যান না। ফলে বাল্যবিবাহের কোনো কাবিননামাও হয় না। এতে পরবর্তীতে বিবাহ বিচ্ছেদের মত ঘটনাতেও কোনো আইনি সহায়তা পায় না তারা।

টাঙ্গাইল সদরের হুগড়া হাবিব কাদের উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শামীম আল মামুন জুয়েল জানান, বিদ্যালয়ের ১ হাজার ৫৫৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৯০ জন মেয়ে। বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছাত্রীর মধ্যে প্রায় ৫০ জনের বিয়ে হয়ে গেছে। এ ছাড়াও ৩০ জন ছাত্র রয়েছে যারা পরিবারের অভাব মেটাতে পড়াশোনা বাদ দিয়ে বিভিন্ন স্থানে কাজ করছে।

কালিহাতীর ফেরদৌস আলম ফিরোজ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শামীম আল মামুন বলেন, বিদ্যালয়টি প্রত্যন্ত অঞ্চলে হওয়ায় এখানে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে ছাত্রীরা। এছাড়া এখানে কিছু পরিবার রয়েছে যারা অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়। এখন পর্যন্ত বিদ্যালয়ের ৪২ জন ছাত্রী পাওয়া গেছে যারা বাল্যবিবাহের  শিকার হয়েছে। তবে এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ছাত্রী বিদ্যালয়ে আসছে।

টাঙ্গাইল জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা লায়লা খানম বলেন, এই মুহূর্তে ছাত্রীদের বাল্যবিবাহের কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। এ বিষয়ে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তথ্য সংগ্রহ শেষে সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানা যাবে। 

অভিজিৎ ঘোষ/আরএআর