চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকায় অনেকের সঙ্গে সেদিন ভাষণ শুনতে রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলেন আব্দুর রব হাওলাদার। ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর জ্বালাময়ী সেই ভাষণ শুনে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। শুধু তিনি নন, মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তার আরও পাঁচ ভাই। একই পরিবারের এতজনের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ছিল বিরল ঘটনা। তাদের এ আত্মত্যাগে গর্বিত এলাকার প্রত্যেক মানুষ।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব হাওলাদারের (৮৪) বাড়ি মাদারীপুর ডাসার উপজেলা পূর্ব মাইজপাড়া গ্রামে। তার বাবা মৃত গনি মিয়া ছিলেন একজন কৃষক। মা মৃত আকলিমা বেগম ছিলেন গৃহিণী। তারা ছিলেন সাত ভাই ও ছয় বোন। আব্দুর রব ছিলেন সবার বড়।

তার অন্য ভাইয়েরা হলেন আব্দুল কাদের হাওলাদার (মৃত), আবদুল মানিক হাওলাদার, রাজ্জাক হাওলাদার, হাবিবুর রহমান হাওলাদার, আবদুস সালাম হাওলাদার। তাদের কনিষ্ঠ ভাই জহীরুল হক হাওলাদার বয়সে ছোট হওয়ায় যুদ্ধে যেতে পারেননি।

সরেজমিনে দেখা যায়, আব্দুর রব হাওলাদার নিজ গ্রামেই বসবাস করেন। তার অন্য ভাইয়েরা প্রবাসী। আর্থিক ও সামাজিকভাবে তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত এবং সমাজে সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ম্যাট্রিক পাস করার পর ১৯৬০ সাল থেকে চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকতেন তিনি। সে সময় পাকিস্তানি বাহিনীর বাংলার মানুষের ওপর অত্যাচার-নিপীড়নের খবর ব্যথিত করত তাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ছিল তার অসামান্য ভালোবাসা। সময় পেলেই ছুটে চলে যেতেন বঙ্গবন্ধুর যেকোনো সমাবেশে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের সেই সমাবেশে গিয়েছিলেন আব্দুর রব হাওলাদার। শেখ মুজিবুর রহমানের সেদিনের জ্বালাময়ী ভাষণ শুনে সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধ করার।

কয়েক দিন পর তিনি চলে আসেন মাদারীপুরের বীরমোহন এলাকায়। সেখানে এক অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর সদস্যের কাছে কয়েক দিন প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে চলে যান তিনি। তবে সামান্য প্রশিক্ষণে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মোকাবিলা সম্ভব নয় বুঝতে পেরে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য তিনি তার চাচাতো ভাইকে নিয়ে ১ এপ্রিল ১৯৭১ সালে ভারতে চলে যান।

পরে তার আরও দুই ভাই আব্দুল কাদের হাওলাদার ও রাজ্জাক হাওলাদারও ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নেন। ভারত থেকে তারা দুই মাসের বেশি প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে আসার পর ছয় ভাই একসঙ্গে যোগ দেন এ অঞ্চলের সংগঠিত হেমায়েত বাহিনীর সঙ্গে (হেমায়েত উদ্দিন, বীর বিক্রম)। তার অন্য ভাইয়েরা হেমায়েত বাহিনীর কাছ থেকেই প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেন।

তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গৌরনদী, বিরিশাল, বীরমোহন, গোপালগঞ্জ, টুঙ্গীপাড়া, ফরিদপুর, মাদারীপুরসহ এ অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ৫ হাজার ৫৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত হেমায়েত বাহিনীতে তারা সাহসিকতা দেখিয়েছেন। তাদের দেশপ্রেম দেখিয়েছেন।

আব্দুর রব হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি বঙ্গবন্ধুর কোনো সমাবেশের খবর পেলেই ছুটে যেতাম সেখানে। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আমি যখন ভাষণটি শুনলাম, তখন আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন লাখ লাখ মানুষ উপস্থিত ছিল। এত মানুষ আমি একসঙ্গে কোনো দিন দেখিনি।

তিনি আরও বলেন, আমরা ছয় ভাই জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছি। দেশকে মুক্ত করতে যুদ্ধ করছে। রাষ্ট্র আমাকে সেই মূল্যায়ন করেছে। আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। তবে আমার বাড়ির সামনের সড়কে একটি সেতুর প্রয়োজন। একটি সেতু হলে মানুষ চলাচল করতে পারবে।

আব্দুর রবের স্ত্রী রিজিয়া বেগম বলেন, আমার স্বামী ও তার ছয় ভাই দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। এটাই আমার জন্য ভাগ্য ও গর্বের বিষয়। আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।

পূর্ব মাইজপাড়া এলাকায় বাসিন্দা মজিবুর রহমান বলেন, তারা ছয় ভাই দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। এলাকাবাসী হিসেবে এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। তারা আমাদের এলাকার অভিভাবক।

মাদারীপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর বাংলার আপামর জনগণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। পূর্ব মাইজপাড়া এলাকার আব্দুর রব হাওলাদার ও তার ভাইদের যুদ্ধে অবদান অবিস্মরণীয়। তা ছাড়া ওই এলাকার অনেক মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

সড়কের বিষয়ে কালকিনি উপজেলা প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটি দ্রুত পাকা করা হবে। তারা কিছুদিন আগে মানববন্ধন করেছেন। এলাকার মানুষ কয়েকবার লিখিতও দিয়েছে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি অল্প সময়ের মধ্যে সড়কটি পাকাকরণের এবং একটি সেতু নির্মাণের।

এনএ