মাত্র আড়াই বছর বয়সে খেলাধুলা করার সময় হঠাৎ বাড়ির পাশের একটি ডোবায় পড়ে যান আবুল বাশার। বাবা-মা তাকে সেখান থেকে তুলে সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু পরে সমস্যা দেখা দেয় তার চোখে। এরপর ধীরে ধীরে হয়ে যান দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। অনেক চিকিৎসা করানো হলেও হারিয়ে ফেলেন দৃষ্টিশক্তি।

কিন্তু তাই বলে কখনো মনের শক্তি হারাননি আবুল বাশার। দুচোখে পৃথিবীর আলো দেখতে না পেলেও মনের আলো দিয়ে ঠিকই তিনি দেখতে পান সবকিছু। তাই সাত সদস্যের পরিবারের ভরণ-পোষণ চলে তার আয়-রোজগারের ওপর।

আবুল বাশারের বাড়ি মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার ৫ নং বালিদিয়া ইউনিয়নের বালিদিয়া গ্রামে। ৪৩ বছর বয়সী আবুল বাশার তিন সন্তানের জনক। তার এই অসম্ভব কর্মদক্ষতার কথা শুনে এখন দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন দেখতে আসেন তাকে। খবর পেয়ে ঢাকা পোস্টও হাজির হয় তার বাড়িতে।

তার দৈনিক কাজের মধ্যে গ্রামের লোকজনের নারকেলগাছ পরিষ্কার করা, নষ্ট টিউবওয়েল সারানো, তালগাছ কেটে সেই রস জ্বালিয়ে গুড় করে বাজারে বিক্রি করা, ঝুড়ি বানানোসহ নানা ধরনের কাজ করতে পারেন তিনি। অবাক করা বিষয় হলো, পানিতে ডুব দিয়ে অনায়াসে মাছ ধরার অসম্ভব ক্ষমতা রয়েছে তার। যা দেখে হতবাক হতে হয়।

আবুল বাশারের বয়োবৃদ্ধ পিতা আবু তালেব বিশ্বাস (৮৩) ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ছেলে মনিরের যখন আড়াই বছর বয়স, তখন একদিন বাড়ির উঠানে খেলা করতি করতি ঘরের পাশে খানার (ডোবা) মধ্যি পড়ে যায়। এরপর খোঁজাখুঁজি করে পানির মধ্যি থেকে তুলে নিয়ে আসি। কয়েক দিন পরেই আমরা বুঝতি পারি মনি চোখে দেখতি পারতিচে না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, কত চিকিৎসে করালাম, যশোর নিয়ে গেলাম, তাও মনির চোখ আর ভালো হলো না।

তবে গর্ব করে তিনি বলেন, চোখি না দেখলিও আমার ছেলে বাশার আমাগের চোখির মণি। আজ আমাগের সাতজনের পরিবার চালায়ে নিয়ে যাচ্ছে সে। আল্লাহ আমার মনির মধ্যি (মধ্যে) কী যে দেছে, ওর কোনো নকমের (রকমের) কাজ করতি সমস্যা হয় না। শুধু ৫ শতাংশ জায়গার ওপর পাটকাঠির বেড়াযুক্ত একটি টিনের ঘর ছাড়া মাঠে তাদের কোনো ফসলি জমি নেই বলে তিনি জানিয়েছেন।

চোখে না দেখলেও কীভাবে নারকেলগাছ পরিষ্কার করেন, কীভাবেই বা ধারালো কাঁচি দিয়ে সেই ডাব-নারকেল কাটতে পারেন, এমন প্রশ্নের জবাবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আবুল বাশার বলেন, আমি যখন জানতি পারলাম আমার চোখ আর ভালো হবে না, তহন ভাবলাম ছোট থাকতি নাই বাবা-মা আমার দেখল, তারা মারা যাওয়ার পরে আমার কিডা দেখবি? আমি তো বুঝা (বোঝা) হয়ে যাব। তাই আস্তে আস্তে বিভিন্ন কাজ করার অভ্যেস গড়ে তুললাম।

তিনি বলেন, গাছের গুড়ায় (গোড়ায়) হাত দিয়েই আমি বুঝতি পারি গাছডা কত বড় হবি। এরপর  গাছে উঠে গাছ পরিষ্কার করি। আর হাতরায়ে হাতরায়ে (হাতড়ে) ডাব-নারকেল পাড়ে নিয়ে আসি। আমি এখন কোনো কষ্ট ছাড়াই তালগাছ কাটি, সেখানে হাঁড়ি পাতে রস পাড়ে আনি। এরপর সেই রস জ্বালায়ে গুড় করে বাজারে বিক্রি করে টাকা রোজগার করি। ধারালো কাঁচি দিয়ে ডাব-নারকেল কাটতে পারার বিষয়ে তিনি বলেন, আমার এখন এটটা (একটা) বুঝ (ধারণা) হয়ে গেছে, তাই খুব সহজেই কাটতি পারি।

তিনি জানান, গ্রামের লোকজনের টিউবওয়েল নষ্ট হয়ে গেলি আমার ডায়ে (ডাকে)। আমি তা সারে দিলি তারা আমার টাকাপয়সা দেয়। তিনি আরও বলেন, আমি ঝুড়ি বানায়ে বাজারে নিয়ে বেচে টাকা রোজগার করি। আব্বা তো বুড়ো আর অচল হয়ে গেছে, তাই আমি যা রোজগার করি তাই দিয়েই কোন মতো সংসার চালাই।

অহম বোধ  রয়েছে আবুল বাশারের। তিন বলেন, একবার গাছেরতে পড়ে যায়ে পিঠির হাড় ভাঙে যায়। তারপর থেয়ে (থেকে) গাছে উঠতি কষ্ট হলিও আমি কারুর (কারো) কাছে হাত পাতিনে।

প্রতিবেশী কলেজছাত্র এম তাওফিক কালাম অভি বলেন, আমাদের গ্রামের সবাই বাশার চাচাকে একনামে চিনে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়েও তিনি বিভিন্ন ধরনের কাজ করে সংসার চালান। গ্রামের কেউ মারা গেলে তিনি কারও সঙ্গে সেখানে গিয়ে বাঁশ কাটাসহ অনেক কাজ করে তাদের সহযোগিতা করে থাকেন। অভি আরও বলেন, বাশার চাচার সব থেকে বড় গুণ হলো তিনি পুকুরে ডুব দিয়ে অনায়াসে মাছ ধরতে পারেন, যা অবিশ্বাস্য।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল বাশার বলেন, আমার অনেক দিন জালেদের (জেলে) সঙ্গে মাছ মারার অভিজ্ঞতা আছে। তাই অনেকের কাছে অবাক করা বিষয় হলিও আমার কাছে কঠিন মনে হয় না। গর্ব করে তিনি বলেন, ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানে হানিফ সংকেত ছার (স্যার) আমার নিয়ে যায়ে ১ লাখ টাকা দিছিল। সেই টাকা দিয়ে আমার মায়েডার (মেয়ে) বিয়ে দিছি। আমি পড়াশোনা জানিনে। প্রশাসন আর সরকার যদি আমার ছেলেগের লেখাপড়া চালানোর একটা ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে খুব উপকার পেতাম।

আবুল বাশারের স্ত্রী নুরনাহার বেগম বলেন, আমার স্বামী চোখি না দেখলিও, সে যা আয়-নোজগাড় (রোজগার) করে তাই দিয়েই আমি খুশিমনে সংসার চালাই। তিনি আরও বলেন, চার বছর আগে বড় মায়েডার বিয়ে দিছি। আইয়ুব হোসেন নামে বড় ছওয়াল (ছেলে) টেনে (দশম শ্রেণি) পড়ে। আর ছোট ছওয়াল মারুফ টুতি (দ্বিতীয় শ্রেণিতে) নেহাপড়া (লিখাপড়া) করে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্বামী অন্ধ হলেও সে আমাগের কোনো কষ্ট বুঝতি দেয় না। একটু ভালো থাহার জন্য অনেক কষ্ট করে।

আবুল বাশারের মা খাদিজা বেগম বললেন, আমার ছওয়াল (ছেলে) বাশার আমাগের চোহির (চোখের) মণি।

স্থানীয় বালিদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. পান্নু মোল্ল্যা বলেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আবুল বাশার একজন করিতকর্মা মানুষ। তিনি দৃষ্টি হারানোর পরও সব কাজে পোক্ত। আমরা তার জন্য গর্ব করি।

মহম্মদপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা কাজী জয়নুর রহমান বলেন, দরিদ্র আবুল বাশার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হলেও বাস্তবে তিনি সক্ষম মানুষ। অনেক ধরনের কাজ করে সংসার চালান। আর হতদরিদ্র হওয়ায় তাকে প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় আনা হয়েছে। তিনি প্রতিবছর ৯ হাজার করে ভাতা পান। পরবর্তী সময়ে তার জন্য সরকারিভাবে যেসব সুবিধা দেওয়া সম্ভব হবে, তার সবকিছুই তার জন্য নিশ্চিত করা হবে।

মহম্মদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রামানন্দ পাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী  আবুল বাশারের বিষয়টি আমি জানি। নিয়ম অনুযায়ী সরকারিভাবে যত ধরনের সুবিধা দেওয়া যায়, তার সবই আমরা বাশারের জন্য করব। এরপর সরকারি ঘরের প্রকল্প এলে আমরা তার জন্য একটি ঘর করে দেব।

এনএ