কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হলেও টাকা ফেরতের আশায় আছেন টাঙ্গাইলের শত শত গ্রাহক। তাই তারা সুযোগ দিতে চান ইভ্যালিকে। তাদের দাবি, ইভ্যালির মালিকদের গ্রেফতারের পর বন্দি করে রাখলে গ্রাহকদের কষ্টার্জিত টাকা ফেরতের সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় দাঁড়াবে। ফলে ইভ্যালি থেকে টাকা ফেরতের জন্য প্রতিষ্ঠানের দুই মালিককে মুক্তি দেওয়ার দাবি করেন তারা।

টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে এসব কথা জানা গেছে।

গত ১৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে একটি মামলায় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে মোহাম্মদপুরের বাসায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে র‍্যাব।

এর আগে ওই দিন সকালে আরিফ বাকের নামের এক গ্রাহক ইভ্যালির অনলাইন প্লাটফর্মে ৩ লাখ ১০ হাজার ৫৯৭ টাকার পণ্য অর্ডার করেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা পাননি এবং তাকে অর্থও ফেরত দেওয়া হয়নি উল্লেখ করে গুলশান থানায় ওই মামলা করেন।

সরেজমিনে জানা যায়, জেলার ভূঞাপুর উপজেলার প্রায় শতাধিক গ্রাহকের প্রায় ১৫ কোটি থেকে ২০ কোটি টাকার পণ্য অর্ডার করা আছে ইভ্যালির কাছে। চমকপ্রদ ও কম দামে পণ্য দেওয়ার অভাবনীয় ছাড়ের লোভে উপজেলার শতাধিক গ্রাহক ইভ্যালিতে টাকা বিনিয়োগ করেছেন। অনেকেই আবার ইভ্যালি পণ্য কিনে লাভবান হয়েছেন। তবে লাভ হওয়ার গ্রাহকদের সংখ্যা খুবই কম পাওয়া গেছে। একে অন্যের কাছে পণ্য কিনে লাভের কথা শুনে ইভ্যালিতে লাখ লাখ টাকার পণ্য অর্ডার দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন গ্রাহকরা।

তবে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হলেও কারও কোনো অভিযোগ নেই। বরং এখনো টাকা ফেরতের আশায় আছেন অনেকেই। এ ছাড়া ই-কমার্স, সিরাজগঞ্জ শপ, দালাল, আলিশা মার্ট, ধামাকাসহ বিভিন্ন ই-কমার্সে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেক গ্রাহক।

এর মধ্যে ভূঞাপুর ইব্রাহীম খাঁ সরকারি কলেজ রোডের প্রায় প্রত্যেক ব্যবসায়ীরা আর. ওয়ানসহ বিভিন্ন মডেলের মোটরসাইকেল, মোবাইল, ফ্রিজসহ একাধিক পণ্য ইভ্যালিতে অর্ডার দিয়ে টাকা পাঠিয়েছেন। এতে শুধু কলেজ রোডের গ্রাহকরা ইভ্যালির কাছে পাবেন প্রায় কোটি টাকা। তবে এসব গ্রাহকের অনেকেই ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি। এ ছাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকার নানা পেশা-শ্রেণির শতাধিক গ্রাহক ইভ্যালিতে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন।

ভূঞাপুর ইব্রাহীম খাঁ সরকারি কলেজ রোডের একটি মোবাইলের দোকানে কাজ করেন সুধন দত্ত। লাভের আশায় ধারদেনা ও ঋণ করে ইভ্যালি মোবাইলসহ কয়েকটি পণ্য অর্ডার করেছেন কয়েক মাস হলো। কিন্তু ইভ্যালির দেওয়া নির্দিষ্ট সময় পার হলেও তিনি পণ্য পাননি। একই অবস্থা ওই রোডের সেভেন ব্রাদার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী শেখ সাদীর। তিনি প্রথম দিকে ইভ্যালিতে পণ্য অর্ডার করে পণ্য পেলেও পরবর্তী সময়ে বেশি অর্ডার করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তিনিও ইভ্যালির সাইক্লোনসহ বিভিন্ন লোভনীয় অফারে পণ্য অর্ডার করে প্রায় ৯ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এমন অনেকেই ইভ্যালিতে বিনিয়োগ করে এখন ক্ষতিগ্রস্ত।

এদিকে উপজেলার গোবিন্দাসী ইউনিয়নের খানুরবাড়ি গ্রামের শিক্ষিত বেকার তিন বন্ধু মিলে ঋণ ও ধারদেনা করে লাভের আশায় ইভ্যালিতে ছয় মাস আগে প্রায় দুই লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। পরবর্তী সময়ে ইভ্যালি থেকে পণ্য ডেলিভারি বন্ধ হওয়া ও প্রতিষ্ঠানের মালিক গ্রেপ্তার হওয়ায় টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। এখন ঋণ পরিশোধ করা নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে।

ইভ্যালির গ্রাহক সুধন দত্ত বলেন, ঋণ ও কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে লাভের আশায় ইভ্যালিতে পণ্য অর্ডার করেছিলাম। কিন্তু মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলেও পণ্য পাইনি। তবে আশায় ছিলাম পণ্য পাব। এখন ইভ্যালির মালিক গ্রেফতার হওয়ায় সেই আশায় চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। এখন টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে খুবই চিন্তায় আছি। তবে ইভ্যালির মালিককে মুক্তি দিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ দিলে হয়তো আমাদের কষ্টার্জিত টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকত।

আরেক গ্রাহক শেখ সাদী বলেন, ইভ্যালিতে প্রথমবার পণ্য অর্ডার দিয়ে পাইলেও পরবর্তী সময়ে অর্ডারে পণ্য পাওয়া যায়নি। এতে বিভিন্ন পণ্য মিলিয়ে প্রায় ৯ লাখ টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। ইভ্যালির শর্ত অনুয়াযী ৪৫ দিনের মধ্যে পণ্য দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সময় পেরিয়ে কয়েক মাস পার হলেও পণ্য পাইনি। এর আগে ইভ্যালিতে একটা চেক দেওয়া হয়েছিল। সেটাও ক্যাশ করতে পারিনি এখনো। এর মধ্যে ইভ্যালির মালিকদের গ্রেপ্তারে গ্রাহকদের পাওনা ফেরতের কোনো সম্ভাবনা নেই। একদিকে পণ্য অর্ডার করে অনেক গ্রাহকই সর্বস্বান্ত। সেখানে প্রতিষ্ঠানের মালিকদের জেলখানায় রাখলে গ্রাহকরা আরও চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ভুক্তভোগী গ্রাহকদের ক্ষতির বিষয়টি চিন্তা করে সরকার ইভ্যালির মালিকদের মুক্তি দিয়ে তাকে সুযোগ দেওয়ার কথা বলেন তিনি।

ইভ্যালির গ্রাহক স্থানীয় এক শিক্ষক শামছুল হক সবুজ বলেন, ইভ্যালির প্রথম যে অর্ডার ছিল, এখানকার অনেকেই তা পেয়েছে। প্রথমে আমি একটা মোটরসাইকেল সময়মতো পেয়েছিলাম। তবে পরবর্তী সময়ে অর্ডারকৃত পণ্যগুলো সময়মতো পাইনি। আশা ছিল নির্ধারিত সময়ে পাব। কিন্তু বর্তমানে ইভ্যালির যিনি মালিক রয়েছেন তিনি যদি এভাবে গ্রেফতার হয়ে থাকেন, তাহলে টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। যদি ইভ্যালির মালিকদের ছেড়ে দেওয়া হয় এবং সে ছয় মাসের সময় চেয়েছিল। আমরা গ্রাহক হিসেবে ইভ্যালিকে সময় দেব। এতে আমরা অর্ডারকৃত পণ্য পাব এবং এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে না গ্রাহকদের।

উপজেলার গোবিন্দাসী ইউনিয়নের খানুরবাড়ি গ্রামের ইভ্যালির গ্রাহক শিশির দাস বলেন, তিন বন্ধু মিলে ঋণ ও ধার দেনা করে কয়েকটি পণ্য অর্ডার করেছিলাম। ইভ্যালির নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হলেও পণ্যগুলো পাইনি। এর মধ্যে আবার ইভ্যালির মালিকদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এতে চরম হতাশায় দিন পার করছি। ইভ্যালির মালিক গ্রেফতার হয়েছে শুনে পাওনাদাররা প্রতিনিয়তই টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। এভাবে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকলেও গ্রাহকরা তাদের টাকা ফেরত পাবে না। বরং মুক্তি দিয়ে তাকে সময় দেওয়া হোক। এতে গ্রাহকদের টাকা ফেরতের সম্ভাবনা থাকবে।

ভূঞাপুর পৌরসভার পূর্ব ভূঞাপুর এলাকার রুহী দাস পাল বলেন, অনলাইন ভিত্তিক ই-কমার্সে কেনাকাটার বিষয়ে ধারণা না থাকলেও অন্যদের দেখাদেখি ইভ্যালিতে কয়েকটি পণ্য অর্ডার করেছিলাম। সবগুলো পণ্যই পিকড অবস্থায় ছিল। এতে ইভ্যালির দেওয়া নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও পণ্য পাইনি এখনো। পরবর্তী সময়ে ইভ্যালির মালিকদের গ্রেফতারে টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে ই-কমার্সে বিনিয়োগ করে অর্ধলক্ষ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।

এনএ