রাত ১১টা। আকবরিয়া গ্রান্ড হোটেলের সামনে আসতে শুরু করেছে শহরের রেলস্টেশন আর সাতমাথায় খোলা আকাশের নিচে থাকা ছিন্নমূল, অবহেলিত ও অসহায় মানুষ। কারণ, সারাদিন অনাহারে-অর্ধাহারে থাকা এই মানুষগুলোর জন্য এক বেলা খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে হোটেলটিতে। তাই রাত ১২টা বাজার আগমুহূর্তে সারিবদ্ধভাবে বসে পড়েন তারা। ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের সামনে চলে আসে গরম গরম খাবার। ভরপেট খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ফিরে যান তারা যার যার বাসস্থানে।

বগুড়ার স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান আকবরিয়া গ্রান্ড হোটেল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতি রাতেই ছিন্নমূল মানুষদের বিনামূল্যে খাবার খাওয়ানোর রেওয়াজ এখনো আছে। কারণ, মরহুম আকবর আলীর নির্দেশে তার পরবর্তী প্রজন্ম এই ছিন্নমূল মানুষদের মুসাফির হিসেবে করেন এই মানবসেবা। এভাবেই পার করেছে সফলতার ১১০ বছর।

হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আকবর আলীর নামেই এর নামকরণ করা হয়েছে। হোটেলের বেঁচে যাওয়া খাবার নয়, বরং তাদের আপ্যায়ন করতে রান্না করা হয় আলাদা করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা করোনাকালীন লকডাউন— কোনো পরিস্থিতিতেই থেমে থাকেনি মুসাফিরদের জন্য রান্না ও খাবার বিতরণ।

দিনে অন্তত এক বেলা খাবারের নিশ্চয়তা পেয়ে বেশ খুশি অসহায় এই মানুষগুলো। তাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ বড় হয়েছেন আকবরিয়ার খাবার খেয়েই।

তেমনই একজন আকবরিয়ার অতিথি দুর্ঘটনায় পা হারানো শ্রী উত্তম কুমার সাহা। তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, তিনি প্রায় ২৫ বছর ধরে আকবরিয়ায় রাতের খাবার খেয়ে আসছেন। তার পা হারানোর আগে তিনি বগুড়ার সবচেয়ে বড় কাঁচাবাজারের গেটে শাকসবজি বিক্রি করতেন। তখন থেকেই আকবরিয়ার খাবার খেয়ে আসছেন তিনি।

আকবরিয়ায় খেতে আসা বেশ কয়েকজন নারী জানান, তারা রেলস্টেশনে থাকেন। জন্মের পর থেকেই আকবরিয়া হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে আসছেন। সারা দিন কোথাও খাবার না পেলে ভরসা থাকে তাদের যে রাতে অন্তত আকবরিয়ায় পেট ভরে খেতে পারব।

দীর্ঘদিন ধরে চলা আকবরিয়ার এমন মানবিক কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন হোটেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। রাত ১২টার পরও কাজ করতে হয় তাদের। উৎসাহবোধ করেন জানিয়ে তারা বলেন, ভালো লাগা থেকেই এই মানুষগুলোর জন্য নির্দিষ্ট সময়ের পরও কাজ করেন তারা।

সারা দিন আকবরিয়া হোটেলে খাবার পরিবেশন করেন, এমন একজন কর্মী জানান, কাজ শেষে হোটেল বন্ধ হওয়ার পর মুসাফিরদের খাবার খাওয়াতে ভালো লাগে। তিনি বলেন, এখানে যারা খেতে আসেন, তারা সারা দিন অনাহারে-অর্ধাহারে থাকেন। তাদের হাতে খাবার তুলে দিলে তাদের হাসিমুখ দেখে খুবই ভালো লাগে। তাই কাজের সময় পেরিয়ে গেলেও এই কাজ করি।

শুধু আকবরিয়া হোটেল-সংশ্লিষ্টরাই মানবিক হয়ে ওঠেননি, অনেকেই মানবিক কারণে খাবার কিনে খেতে আসেন এখানে। তারা বলছেন, তাদের কাছে বিক্রি করা খাবারের লভ্যাংশের একটা অংশ দিয়েই এই ছিন্নমূল মানুষদের রাতের খাবারের আয়োজন করা হয়।

হোটেলে কিনে খেতে আসা সাধারণ মানুষ জানান, আকবরিয়া বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী একটি হোটেল। এখানকার খাবারের মান ভালো। তা ছাড়া আকবরিয়া প্রতি রাতে ছিন্নমূল মানুষদের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করে, এমন ভালো কাজে শরিক হতেই এখানে নিয়মিত খেতে আসেন তারা।

আরও জানা যায়, এসব মানবিক কাজের পাশাপাশি আকবরিয়া গ্রুপ শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসারেও কাজ করে যাচ্ছে। তাই সচেতন মহল বলছে, বগুড়ার অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও এভাবে কাজ করলে উপকৃত হবে এ অঞ্চলের মানুষ।

বগুড়ার সাংস্কৃতিক কর্মী মো. সুজন ও নিভা রানী পূর্ণিমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আকবরিয়ায় শুধু রাতে ছিন্নমূল মানুষকেই খাওয়ায় না, এ ছাড়াও তারা সব সময় গরিব-অসহায়দের সাহায্য করে থাকে। আকবরিয়া গ্রুপ করোনাকালীন সাধারণ মানুষের পাশে থেকে যেভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে, তা অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুসরণ করা দরকার।

মরহুম আকবর আলীর কনিষ্ঠ ছেলে আকবরিয়া গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান হাসান আলী আলাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আকবরিয়া যত দিন থাকবে, এমন মানবিক কাজ তত দিনই চলবে। আমার পূর্বপুরুষদের নির্দেশে আমি সেভাবে এই কাজ করে যাচ্ছি। আবার ঠিক সেভাবেই আমার পরবর্তী প্রজন্মকে তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য তৈরি করছি।

তিনি আরও বলেন, আমার বাবা মরহুম আকবর আলীর নির্দেশ ছিল, আকবরিয়া যত দিন থাকবে, মুসাফিররাও যেন তত দিন আকবরিয়ায় রাতের খাবার খেতে পারে। তাই আমরা এই মানুষগুলোকে আমাদের পরিবারের সদস্য মনে করি। আমাদের পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠান বা সামাজিক অনুষ্ঠানে তাদের ভালো খাবার খাওয়াই।

উল্লেখ্য, প্রতিদিন প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ জন মানুষকে বিনামূল্যে খাবার দিয়ে আসছে আকবরিয়া গ্রুপ। এ ছাড়া প্রায় আড়াই হাজার মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী এই আকবরিয়া গ্রুপে।

এনএ