বিয়ের ক্ষেত্রে ঘটকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর সেটা যদি হয় পারিবারিক বিয়ে তাহলে তো কথাই নেই। পাত্র-পাত্রী পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করানো ঘটকের কাজ। বর্তমানে এ পেশাটিতে উচ্চ শিক্ষিতদের আগ্রহ বাড়ছে। এমনই একজন রংপুরের রিদওয়ান নুর রহমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা চুকিয়ে ঘটকালিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন এই যুবক।

ঘটকের কথা বললে এক সময় চোখের সামনে ভেসে উঠত- পাঞ্জাবি পরা, মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি আর বগলে ছাতা নিয়ে হেঁটে চলা ব্যক্তির প্রতিচ্ছবি। তবে সময়ের সঙ্গে ঘটকের পোশাকে যেমন পরিবর্তন এসেছে তেমনি পাত্র-পাত্রী বাছাই বা দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে।

রিদওয়ান নুরের ভাষায়, পাত্র-পাত্রীর আর্থ-সামাজিক মর্যাদা, শারীরিক গঠন, গায়ের রং বা মতাদর্শ মিলিয়ে মিল-মিশ করার জটিল ও দুঃসাধ্য কাজটি করছেন তিনি।

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ঘটকালি করছেন রিদওয়ান নুর। চলাফেরা ও কথাবার্তায় শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও মনোবলে বেশ এগিয়ে এ যুবক। ঘটকালির আড়ালে সামাজিক ব্যাধি যৌতুককে না বলতে এবং দেনমোহর কম করাতে পাত্র-পাত্রী পক্ষকে উদ্বুদ্ধ করছেন। রিদওয়ানের ঘটকালিও একটু ব্যতিক্রম। তিনি শুধু শিক্ষিত পরিবারের বিবাহযোগ্য ছেলে-মেয়েদের জন্য কাজ করছেন।যৌতুক লোভীদের জন্য ঘটকালিতে তার না রয়েছে। এখন পর্যন্ত যৌতুকবিহীন সাতটি বিয়ে দিয়েছেন। অনেকের চোখে এটাই রিদওয়ান নুরের ঘটকালির সফলতা।

রিদওয়ান নুর রহমান বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও সেশনজটের কারণে স্নাতকোত্তর শেষ হয় ২০১৯ সালে। এরপর পেশা নির্বাচন নিয়ে ভাবতে থাকেন। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকায় সরকারি চাকরি বা অন্য পেশায় যেতে বেশি আগ্রহী ছিলেন না তিনি। বরং নিজে উদ্যোক্তা হয়ে স্বাধীন থাকার কথা চিন্তা করতে থাকেন। ঠিক তখনই তার এক বাল্যবন্ধুর জন্য পাত্রীর সন্ধান করতে গিয়ে ঘটকালিতে আগ্রহ জন্মে রিদওয়ানের।

রিদওয়ান নুর ঢাকা পোস্টকে জানান, তার বন্ধু তৌফিক আহমেদের বিয়ের জন্য পাত্রীর খোঁজ করতে গিয়ে মনের সঙ্গে মিলে যায় ঘটকালি পেশা। সেই ভালো লাগা থেকেই শুরু করেন ঘটকালি। কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি সম্পন্ন রিদওয়ান তার নামের আগে লিখে ফেলেন ‌‘ঘটক’। খুলে ফেলেন ‘ঘটক জি’ নামে একটি ম্যারেজ মিডিয়া প্রতিষ্ঠান।

প্রথমবারেই সফল হন রিদওয়ান। ওই বছরের নভেম্বরে বন্ধু তৌফিক আহমেদকে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জুনিয়রের সঙ্গে পারিবারিক মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিয়ে দিতে সক্ষম হন। এতে বর-কনে উভয় পক্ষ থেকে ভালো সম্মানীও মেলে। উৎসাহ পান তিনি। পেশাদারিত্বের সঙ্গ শুরু করেন ঘটকালি। 

আর্থ-সামাজিক অবস্থা বা শিক্ষা-দীক্ষা বিবেচনায় নিয়ে কীভাবে পাত্র-পাত্রী মিল করান? এ বিষয়ে রিদওয়ান নুর জানান, পাত্রের বংশ, চাকরি, লেখাপড়া দেখে সেই রকম বংশের লেখাপড়া জানা পাত্রীর কথা বলতে হয়। সব বংশে তো আর সব প্রস্তাব দেওয়া যায় না।  তবে মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত পরিবারের বিবাহযোগ্য পাত্র-পাত্রীদের জন্য তিনি কাজ করেন। যৌতুক নিয়ে বিয়ে করতে আগ্রহীদের কাজ হাতে নেন না। এখন পর্যন্ত যে সাতটি বিয়ে দিয়েছেন তাদের কেউ যৌতুক নেননি।

অভিজ্ঞতার ঝুড়ি থেকে রিদওয়ান বলেন, বিয়ের জন্য পাত্র-পাত্রী মিলমিশ করার জন্য এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মাধ্যম আত্মীয়-স্বজন বা চেনা-পরিচিত মানুষজন। এখনও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ে এ দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগের শুরুটা স্বজন বা পরিচিতজনদের মাধ্যমে ঘটে। তবে ব্যস্ততাসহ বিভিন্ন কারণে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে যোগাযোগ কমে যাচ্ছে। এ কারণে বিয়ের পাত্র-পাত্রী খোঁজার ক্ষেত্রে ঘটকের গুরুত্ব রয়েছে।

তার আপত্তি সিনেমা বা নাটকের পর্দায় দেখা ঘটকদের নিয়ে। নান্টু ঘটকের কথা শুইনা অল্প বয়সে করলাম বিয়া- এই অপবাদ শুনতে চান না তিনি। এ কারণে রিদওয়ান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটক বলতে যা বোঝায়, আমি ঠিক তা না। তবে তড়িঘড়ি করে বিয়ে দেওয়ার পক্ষে আমার কখনও আগ্রহ ছিল না। বরং পাত্র-পাত্রীর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়গুলো ভালো করে জানতে এবং জানাতে চেষ্টা করি।

তিনি আরও জানান, অনেকেই বলে এত পড়াশুনা করে এই পেশায় কেন? নিরুৎসাহিত করেন। কিন্তু এসব কথা কানে তোলেন না রিদওয়ান। তার কথা, কেউ তো ক্যারিয়ার গড়ে দেবে না। অভাবে পড়লে দুই টাকা দিয়ে সাহায্য করবে না। এ কারণে নিজেকে ঘটক বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি।

রিদওয়ান ছোটবেলা থেকে শারীরিক কিছু প্রতিবন্ধকতায় ভুগছেন। চার বছর বয়সে জেনারেল মরফিয়া রোগে আক্রান্ত হন তিনি। এরপর থেকে তার পা বাঁকা হয়ে যায়। কোমর ব্যথা করতে থাকে। সমস্যা হয় কথা বলতে। এসব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এতদূর এসেছেন। তার বাবা নেই। মা একটি সরকারি ব্যাংকের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। রিদওয়ান নুর তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। থাকেন রংপুর নগরীর ধাপ এলাকায়।

এদিকে রিদওয়ানের বন্ধু আব্দুর রাজ্জাক ঢাকা পোস্টকে বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও রিদওয়ান খুব উদ্যমী। তার মতো তরুণ উদ্যোক্তার অভাব আমাদের রয়েছে। ঘটক জি ম্যারেজ মিডিয়া শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের বিয়ের জন্য মিল করানোর যে উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে তা প্রসংশনীয়। বিশেষ করে যৌতুক ছাড়া কম দেনমোহরে বিয়েতে দুই পক্ষকে উদ্বুদ্ধ করার বিষয়টি খুবই ভালো উদ্যোগ।

চাকরিজীবী সাব্বির আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটক জির কাজে বোঝার উপায় নেই তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী। বরং প্রতিবন্ধকতা ভুলে মনোবল দৃঢ় করে শিক্ষিতদের জন্য বিবাহবন্ধন সম্পর্কিত একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে, যা সত্যি প্রসংশার দাবি রাখে। আমরা চাইলে তার প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নিজেদের পছন্দসই মানুষকে খুঁজে নিতে পারব।

বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে ঘটক পেশায় আসাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. মিজানুর রহমান। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, কোনো পেশাকে ছোট হিসেবে দেখতে নেই। রিদওয়ান নুরের ঘটকালির বিষয়ে শুনেছি। শিক্ষিত তরুণরা এগিয়ে এলে এ পেশা সমৃদ্ধ হবে।

এসপি