শারীরিক প্রতিবন্ধকতা একজন মানুষের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। চাইলেও সে মানুষটি সমাজের আর দশজনের মতো বেড়ে উঠতে পারে না। ফলে অনেক সুপ্ত প্রতিভা বাধার দেয়াল ডিঙিয়ে মেধার ক্রমবিকাশ ঘটাতে ব্যর্থ হয়। আবার ব্যতিক্রম গল্পও আছে এই সমাজে। যারা প্রবল ইচ্ছাশক্তি দিয়ে নিজের প্রতিবন্ধকতা জয় করে সাফল্যের জীয়নকাঠি ছুঁয়েছেন। তেমনই এক অদম্য কিশোর যশোরের জাহিদুল। শরীরের অতিগুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ দুটি হাত নেই, তবে স্বপ্ন ছুঁতে তারও চলছে প্রাণান্ত চেষ্টা।

২০০৭ সালে যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে জাহিদুল, তখন বিদ্যুৎস্পৃষ্টে আহত হয় সে। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে হারাতে হয় দুটি হাত। কিন্তু দুর্দমনীয় ও অসীম সাহসিকতা তাকে তাড়া করত সব সময়। সেই প্রেরণা থেকে শুরু করে লেখাপড়া। ২০১৫ সালে পিইসি পরীক্ষায় জিপিএ-৪.৭৫ এবং ২০১৯ সালে জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৩.০০ পেয়ে উত্তীর্ণ হয় সে।

শুধু তা-ই নয়, পাশাপাশি সাইকেল চালানো, খেলাধুলা, সাঁতার কাটাসহ দৈনন্দিন সব কাজ করে স্বাভাবিকভাবেই। সবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলে জাহিদ। জীবনযুদ্ধে হারতে নারাজ বহু প্রতিভার অধিকারী জাহিদুল তাই এলাকায় পরিচিত হয়েছে বিস্ময়বালক হিসেবে। তাই এখন সে স্বপ্ন দেখে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার।

যশোরের মণিরামপুর উপজেলার শ্যামকুড় ইউনিয়নের আগরহাটি গ্রামের মাহাবুবুর রহমান ও রাশিদা বেগম দম্পতির ছোট ছেলে জাহিদুল ইসলাম। তারা বাবা স্থানীয় একটি ইটভাটায় চাকরি করেন। জাহিদ বর্তমানে স্থানীয় ধলীগাতী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির মানবিক বিভাগে অধ্যয়নরত।

সরেজমিনে গেলে জাহিদুলের পরিবার জানায়, ২০০৭ সালের একদিন বিকেলে এক প্রতিবেশীর নির্মাণাধীন বাড়ির ছাদে খেলার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় সে। এতে তার হাতের কনুই পর্যন্ত পুড়ে যায়। তাকে উদ্ধার করে প্রথমে মণিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। তার অবস্থা দেখে সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে খুলনায় নেওয়ার পরামর্শ দেন। পরে সেখানে অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হয় জাহিদুলকে।

তত দিনে তার হাতের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। সেখানকার চিকিৎসকরা জানান, অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই জাহিদুলকে বাঁচাতে হলে তার হাত আর রাখা যাবে না। তাই অস্ত্রোপচার করে তার ডান হাতের কনুইয়ের নিচ থেকে এবং বাঁ হাত বাহুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়। হাতের ঘা শুকাতে সময় লাগে মাস পাঁচেকের মতো। ঢাকা থেকে পাঁচ মাস পর জাহিদুলকে বাড়িতে চলে আসেন তার মা-বাবা।

একপর্যায়ে জাহিদুলের মাঝে পড়ালেখার আগ্রহ তৈরি হয়। শুরু হয় দুই হাতের কাটা অংশে কলম চেপে ধরে খাতায় লেখার চর্চা। আস্তে আস্তে সে লিখতে শেখে। লেখাপড়ার প্রতি প্রবল ইচ্ছাশক্তি দেখে তাকে লাউড়ী রামনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। এবার জাহিদুল এসএসসি পরীক্ষার্থী।

রাশিদা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, লেখাপড়া করলেও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা চিন্তিত। ও যত বড় হচ্ছে, আমার চিন্তা দ্বিগুণ হচ্ছে। পড়াশোনার পাশাপাশি সে তার নিজের কাজ নিজেই করতে পারে। জাহিদুল তার নিজের জামাকাপড় নিজেই পরতে পারে। তবে জামার বোতাম ও প্যান্টের চেইন আটকাতে পারে না। খাবার মাখতে পারেন না। খাবার মেখে দিলে খেতে পারে।

জাহিদুলের বাবা স্থানীয় একটি ইটভাটায় কাজ করে। তার আয় দিয়েই আমাদের সংসার চলে। জাহিদুল লেখাপড়া করে একটি চাকরি পেলে সমাজের আর দশটা প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়েও তাকে অনুসরণ করতে পারবে। তাই জাহিদুলের প্রতি সরকারের একটু নজর দেওয়ার আকুতি জানান রাশিদা বেগম।

জাহিদুলের বড় ভাই তৌহিদুল ইসলাম বলেন, কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর জাহিদুলকে যখন আমরা বাড়িতে নিয়ে আসি, প্রতিবেশীরা তাকে দেখে আফসোস করে বলত, ছেলেটার আর পড়াশোনা হবে না। কিন্তু সহপাঠীদের স্কুলে যেতে দেখলে জাহিদুলেল চোখের কোণে পানি আসত। তার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে আমার বাবা-মা তাকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন।

তিনি বলেন, এভাবেই সে পিইসি ও জেএসসি পাস করে। এখন সে এসএসসি পরীক্ষার্থী। এখন সে নিজের কাজ নিজেই করে। সব ধরনের খেলাধুলা করার পাশাপাশি টিকটক ভিডিও বানায়, কম্পিউটার চালায়। আমরা ওর কোনো কাজে বাধা দিই না। বরং উৎসাহ দিই।

প্রাণবন্ত জাহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলে, নিজের শারীরিক অক্ষমতাকে শক্তিতে রূপান্তর করে জীবনের পথে এগিয়ে যাচ্ছি আমি। দুটি হাত না থাকলেও সাইকেল চালানো, খেলাধুলা, সাঁতার কাটাসহ দৈনন্দিন সব কাজ করতে পারি। ছোটবেলা থেকে নিজের ইচ্ছাশক্তি, চেষ্টা ও সার্বক্ষণিক মায়ের সহযোগিতা পেয়ে হাত না থেকেও সব কাজ শেখা সম্ভব হয়েছে। শুরুতে ভীষণ কষ্ট হতো। এলোমেলো হয়ে যেত লাইন। কলম ধরতে ধরতে একসময় হাতে ইনফেকশনও হয়েছিল। ডাক্তারও বারণ করেছিলেন এভাবে লিখতে। তবে আমি হার মানিনি।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জাহিদুল জানায়, পড়াশোনা শেষ করে একটি সরকারি চাকরি করতে চায় সে। চাকরি না পেলে কোনো ক্রিকেট ক্লাবে প্রতিবন্ধী কোটায় খেলার স্বপ দেখে সে। সেই সঙ্গে সরকারের কোনো সহযোগিতা পেলে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ড অংশ নিতে চাই। এ ছাড়া ছোটবেলা থেকে তার ইচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার। স্বপ্ন দেখে অনেক বড় হওয়ার।

জাহিদুলের বন্ধু সামিউর ইসলাম কনক বলে, খুব অল্প বয়সে জাহিদুল দুর্ঘটনায় দুই হাত হারিয়েছে। তার এই সমস্যা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে তার একটু সময় লেগেছে। তারপরও আমরা স্বাভাবিক মানুষ দৈনন্দিন জীবনে যা করতে পারি, জাহিদুল তার সবকিছুই করতে পারে। এগুলো দেখে আমরাও মুগ্ধ।

আবু হাসান নামের এক প্রতিবেশী জানান, জাহিদুলের মধ্যে ছোটবেলা থেকে আলাদা কৌতূহল দেখতে পাই। লেখাপড়ার প্রতি উৎসাহ দেখে আমিই তাকে বলেছিলাম স্কুলে ভর্তি হতে। কিন্তু ওর মা-বাবা বলে, দুই হাত নেই। স্কুলে গিয়ে জাহিদুল কী করবে! আমি বলেছিলাম, ও কীভাবে লিখবে, কীভাবে পড়বে, সেটা সরকার আর জাহিদুল বুঝবে। তোমরা শুধু জাহিদুলকে স্কুলে ভর্তি করে দাও। তারপর থেকে সে সুন্দরভাবে বেড়ে উঠেছে।

ধলীগাতী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হাবিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, জাহিদুলের শারীরিক অপূর্ণতা আছে। তার দুটি হাত নেই কিন্তু তার হাতের লেখা অন্য শিক্ষার্থীদের চেয়েও ভালো। লেখাপড়ায়ও সে ভালো। আবার স্কুলের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় সে। আমরা মনে করি, এ ধরনের ছেলেদের পাশে যদি একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তারা পিছিয়ে থাকবে না।

মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ জাকির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সমাজে শারীরিক প্রতিবন্ধীরা যে বোঝা নয়, জাহিদুল তার জ্বলন্ত উদাহরণ। সে নিজে পরিশ্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে। জাহিদুলের প্রতিভায় মুগ্ধ প্রতিবেশী ও তার বন্ধুরা। এই সমাজের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে জাহিদুল। তবে তার শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তাকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করব। সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সরকারিভাবে আমরা চেষ্টা করছি।

এনএ