পানির অপর নাম জীবন। তাহলে নদীর নাম কী? উত্তর নদীও জীবন, যদি সেখানে পানি থাকে। তবে দিন দিন পানি শূন্যতার যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা নদীর চিৎকার বাড়ছে। লম্বা হচ্ছে নিখোঁজ নদীর গল্প। দখল, দূষণ আর আবাসনে মৃত্যু হচ্ছে একেকটি নদীর। কখনও আবার ভূমিকম্প ও ভয়াবহ বন্যায় গতিপথ বদলে নদী হারিয়েছে স্বাভাবিক গতি। প্রাণহীন নদীতে বসেছে মানুষের ভাগ। দখল তাণ্ডবে নদীর বুকে গড়ে উঠেছে বসতবাড়ি, পুকুর, ধানি জমি। রংপুরে এমন নিখোঁজ নদীর প্রাণ ফেরাতে কাজ করছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)।

সম্প্রতি মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়া ‘মরা তিস্তা’ আর ‘ঘিরনই নদী’ খনন করা হয়েছে। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া শাখা এ নদী দুটির ১৭ কিলোমিটার অংশ দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে। এতে করে প্রায় দুইশ বছর পর জেগে উঠছে মরা তিস্তা নদী। সঙ্গে প্রাণ ফিরে হাসছে ঘিরনই নদী। অথচ কিছু দিন আগেও এ নদী দুটি ছিল অস্তিত্বহীন। এবার শুধু নদী খনন নয়, দুই পাড় সংরক্ষণ ও পরিবেশ উন্নয়নে তীরবর্তী এলাকায় বিভিন্ন ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে।

উদ্ধার মরা তিস্তা নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিকলী ও যমুনেশ্বরী নদীর মূলধারা। চলতি বর্ষা মৌসুমে পানিতে পেট ভরেছে এ নদীর। এখন মরা তিস্তা নদীর বুকে খেলা করে হাঁস। বেড়েছে বক, পাতি সরালি, মাছরাঙার আনাগোনা। হরেক রকম পাখির দেখা মিলছে মরা তিস্তার বুকে। যমুনেশ্বরী নদী তীরবর্তী এলাকা থেকে ফসল বোঝাই করে নৌকাও চলতে দেখা গেছে মরা তিস্তায়।

নদী গবেষক ও নদী আন্দোলন সংগ্রামীরা বলছেন, জলের আধার, আমিষের উৎস এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখবে উদ্ধার হওয়া এ নদীটি। হারিয়ে যাওয়া মরা তিস্তা নদী তার স্বাভাবিক গতি ফিরে পেয়েছে। নদী উদ্ধারে মরা তিস্তা হতে পারে দৃষ্টান্ত এমনটাই দাবি তাদের।

বিএমডিএ ও স্থানীয় এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ১৭৭৬ সালের রেনেল মানচিত্রে প্রদর্শিত তিস্তার একটি শাখা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার দক্ষিণাংশ থেকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলা দিয়ে প্রবেশ করে। নদীটি নীলফামারী জেলা অতিক্রম করে রংপুর জেলার তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিঠাপুকুর উপজেলার শেষভাগে করতোয়া নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। রেনেল মানচিত্রে এ নদীকে তিস্তা নামেই উল্লেখ করা হয়েছে।

১৭৮৭ সালে ভূমিকম্প ও ভয়াবহ বন্যায় গতিপথ পরিবর্তন করে তিস্তা। এর ফলে উত্তরবঙ্গের নদীগুলো স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলে। শাখা এ নদীটি তিস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিস্তা নামটি বিলুপ্ত হয়ে এলাকাভিত্তিক চাড়ালকাটা, যমুনেশ্বরী ও দেওনাই নামে পরিচিতি পায়। একইসঙ্গে এর অংশ দখলদারদের কুনজরে পড়ে সংকীর্ণ হতে থাকে। বন্ধ হতে থাকে নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ।

সময়ের পরিবর্তনে অনেকে নদীর মালিক হয়ে যায়। এ নদীটি এক সময় মানুষের বসতভিটা, পুকুর, ধানি জমি, গো-চারণভূমিতে পরিণত হয়। আগে বন্যার সময় এটি চিকলী ও যমুনেশ্বরী নদীর প্রবাহ বজায় রাখত। সে প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রতি বছর প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমি জলাবদ্ধ ও বন্যাকবলিত হয়। নদী না থাকায় অনেক মৎস্যজীবী পেশা হারিয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে নিখোঁজ নদী উদ্ধার ও দখলমুক্তকরণে পরিকল্পনার ছক আঁকেন বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। তাদের উদ্যোগে পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে বৃহত্তর রংপুর জেলায় সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্পের (ইআইআরপি) মাধ্যমে খাল, ছোট নদী খনন কার্যক্রম শুরু হয়। এরই অংশ হিসেবে বদরগঞ্জের হারিয়ে যাওয়া মরা তিস্তা নদীর প্রবাহ এলাকা শনাক্ত করে চলতি বছর ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসে ১৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ নদীটি খনন করা হয়। এতে করে যুগে যুগে মানুষের দখলে চলে যাওয়ার প্রায় দুইশ বছর পর প্রাণ ফিরে পেয়েছে ‘মরা তিস্তা’ নদী।

বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ বলছে, ১৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ‘মরা তিস্তা’ ও ৩ দশমিক ২৬৫ কিলোমিটারের ‘ঘিরনই নদী’ দুটি উদ্ধারের পর তা খনন করা হয়েছে। সঙ্গে মরা তিস্তার উৎসমুখ চিকলী নদীর সঙ্গে সংযুক্ত করে বদরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ, সর্দারপাড়া, বানিয়াপাড়া, কুমারপাড়া, শংকরপুর, ঝাড়পাড়া, সরকারপাড়া, কালুপাড়া ও বৈরামপুর অতিক্রম করে কুতুবপুর ইউনিয়নের কাঁচাবাড়ীর পূর্বদিকে কুঠিপাড়া ঘাটের কাছে যমুনেশ্বরী নদীর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়। ফলে বদরগঞ্জ উপজেলা সদর বন্যার কবল থেকে রক্ষা পাবে। এটি দখলদারদের কাছ থেকে নদী উদ্ধারে এক অন্য রকম দৃষ্টান্ত।

বর্তমানে প্রাণ ফিরে পাওয়া মরা তিস্তার দুধারে পাড় সংরক্ষণ ও পরিবেশ উন্নয়নে নদী-তীরবর্তী এলাকায় বিভিন্ন ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। এখন এসব চারা গাছ লিক লিক করে বেড়ে সবুজায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের জন্য ১১.৫৯ একর খাসজমি উদ্ধার করে তা খনন করা হয়েছে। যেখানে মানুষজন দৈনন্দিন কাজে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে। সেখানে হাঁস ও মাছ চাষের পাশাপাশি সঞ্চিত পানি সেচ কাজে ব্যবহার করতে পারছে।

মরা তিস্তার প্রাণ ফেরার সঙ্গে প্রাণ ফিরেছে এককালের ঐতিহ্যবাহী করতোয়া নদীর সর্বশেষ প্রবাহের ক্ষীণ অস্তীত্বের স্মৃতিচিহ্ন ‘ঘিরনই’ নদীতেও। সময়ের পালা বদলে এ নদীটি নালা বা খালে পরিণত হয়। ঘিরনই নদীর বর্তমান উৎপত্তিস্থল নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলার বাঙ্গালীপুর ইউনিয়নের বিলাঞ্চলে। সেখান থেকে এটি চার কিলোমিটার প্রবাহিত হওয়ার পর মুচিরহাট এলাকা দিয়ে বদরগঞ্জ উপজেলায় প্রবেশ করে।

ঘিরনই নদীটি করতোয়া নামে রংপুর-দিনাজপুর সীমানা বরাবর ৩৬ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে বদরগঞ্জের বকসীগঞ্জ ব্রিজের উজানে দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলা থেকে প্রবাহিত হয়ে সোনারবান (সোনারবন্ধ) নামে অপর একটি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই মিলিত প্রবাহ ‘ঘিরনই’ নামে বদরগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণপুর ও লোহানীপাড়া ইউনিয়নের সীমানা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নবাবগঞ্জ উপজেলার বিনোদনগর ইউনিয়নে করতোয়া নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ঘিরনই নদীর দৈর্ঘ্য ৪৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে চলতি বছর (২০২০-২০২১) এই নদীর ৩ দশমিক ২৬৫ কিলোমিটার পুনঃখনন করা হয়েছে। ফলে খনন করা অংশের দুপাড়ের চারটি গ্রামের জনগণের দৈনন্দিন গৃহস্থলি কাজে নদীর পানি ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয়রা বলছেন, এই নদী খননের কাজ করায় অনেক ভালো হয়েছে। নদীতে পানির প্রবাহ ঠিক থাকলে এই অঞ্চলের মানুষের অনেক সুবিধা হবে। শাখা নদীর পানি ব্যবহারের মাধ্যমে বড় পরিবর্তন আসবে এলাকার কৃষিকাজে। বদলে যাবে এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি।

মরা তিস্তা তীরবর্তী কালুপাড়া ইউনিয়নের শংকরপুর ডাংগারপাড়ার গ্রামের কৃষক ইউনুস মণ্ডলের চোখেমুখে উচ্ছ্বাস। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাপ-দাদার আমলে এটা নদী ছিল। আমরা অনেক মাছ ধরেছি। এখন নদীতে পানি আছে। পানি থাকা মানেই প্রাণ ফিরেছে। অথচ কিছু দিন আগেও এ নদীটি খালের মতো ছিল। খনন করার পর ভালো হয়েছে। আমরা যারা নদীর পাশে আবাদ করি তাদের জন্য অনেক সুবিধা হয়েছে।

বরেন্দ্র অঞ্চলে খরার প্রভাব দূর করতে হারিয়ে যাওয়া ছোট নদীগুলোর প্রবাহ নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করেন পরিবেশবাদীরা। অন্যদিকে নদী গবেষকদের দাবি, নদী তীরবর্তী কৃষি, প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নদী উদ্ধার প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

হারিয়ে যাওয়া নদী উদ্ধারে মরা তিস্তা অনুকরণীয় হতে পারে বলছেন নদী গবেষকরা। রিভারাইন পিপল বাংলাদেশের পরিচালক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ওই অঞ্চলের কৃষি, জীব বৈচিত্র্য এবং পরিবেশের একটি অভাবনীয় ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে। দেশের প্রত্যেক এলাকার নদ-নদীকে বাঁচাতে সরকারের পক্ষ থেকে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। একইসঙ্গে উত্তরের জীবনরেখা তিস্তা নদীকে ঘিরে প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে হবে।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প রংপুরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান খান জানান, দীর্ঘ দিন সংস্কারের অভাবে নদীগুলো ভরাট হয়ে গেছে। গোচারণভূমি হয়ে গেছে। অনেকেই চাষাবাদ করত। ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতো, বন্যা হতো, ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হতো। জলাবদ্ধ থাকা জমিগুলো এখন চাষের উপযোগী হয়ে উঠছে। এখন মরা তিস্তা আবার তার হারানো যৌবন ফিরে পেয়েছে। সেখানে প্রায় ২০টি গ্রামের ৫ হাজার হেক্টর জলাবদ্ধ জমি এখন চাষ উপযোগী হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, নদী এবং বিল খননের ফলে এলাকাবাসীর দৈনন্দিন কাজে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কৃষক এখন বাড়তি সুবিধা পাবেন। স্থানীয়রা নদী উদ্ধারের সুফল ভোগ করতে পারছেন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে নদীর দুধারে গাছ লাগানো হচ্ছে। চলমান এই কার্যক্রম প্রাকৃতিক জীব-বৈচিত্র্য ও পরিবেশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি এলাকার বিনোদনের জায়গা হিসেবে বিলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সিনিয়র উপ-সহকারী প্রকৌশলী ফজলুল হক বলেন, মরা তিস্তা ছিল অস্তিত্বহীন নিখোঁজ নদী। আমরা মানচিত্র ধরে মাঠ পর্যায়ে এ নদীর সন্ধান করেছি। নদীর বিভিন্ন অংশ মানুষের দখলে ছিল। অনেকেই এ নদীকে কাগজে কলমে বাপ-দাদার সম্পত্তি বানিয়ে নিয়েছিল। এ পরিস্থিতিতে নদী খনন ও উদ্ধার প্রক্রিয়া আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা এলাকাবাসীর সঙ্গে একাধিক সভা করেছি। তাদের নদীর গুরুত্ব ও প্রভাব বোঝাতে আমরা সক্ষম হয়েছি। তারা স্বেচ্ছায় নদীর জমি ছেড়ে দিয়েছেন। পরে প্রশাসন ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় নদী খনন করা হয়েছে। এখন সেখানকার মানুষরা মরা তিস্তার জেগে উঠার সুবিধা যুগ যুগ ধরে ভোগ করতে পারবেন।

এসপি