বৃষ্টি হলেই কাদামাটি মেখে চলাচল করতে হয়। জুতা তো দূরের কথা, খালি পায়েও ঠিকমতো হাঁটা যায় না। কেউ অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া কি যে যন্ত্রণা বলে বোঝাতে পারব না। উন্নয়নের কথা শুধু শুনেই গেলাম, কখনও চোখে দেখলাম না। কতজন কত প্রতিশ্রুতি দিল। আমাদের রাস্তাঘাটের কোনো উন্নয়ন হলো না। কষ্টের সঙ্গেই আমাদের বসবাস। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে এভাবে আক্ষেপ করছিলেন বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার বহরবুনিয়া ইউনিয়নের শতবর্ষী বৃদ্ধ আব্দুল কাদের শিকদার।  

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার বহরবুনিয়া ইউনিয়নে যেতে পার হতে হয় নদী। পানগুছি ও কেওড়া নদী সংলগ্ন ইউনিয়নটির মধ্যদিয়ে বয়ে গেছে ৬৭টি ছোট-বড় খাল। প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ ৩৮ বর্গকিলোমিটারের এই ইউনিয়নে বাস করেন ৩৬-৩৭ হাজার মানুষ।

তবে নদীবেষ্টিত ইউনিয়নটিতে পাকা রাস্তা বলে কিছু নেই। নেই কোনো বেড়িবাঁধ। ভাঙাচোরা যেসব কাঁচা রাস্তা রয়েছে সেগুলোও তলিয়ে যায় প্রতি বর্ষায়। সামান্য বৃষ্টিতে শুকনো মৌসুমেও রাস্তাটি চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও রাস্তাঘাট পাকা হয়নি। নির্বাচন এলেই প্রার্থী ও রাজনৈতিক নেতারা বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিলেও নির্বাচিত হওয়ার পর তারা সব ভুলে যান বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

এদিকে অসুস্থ ও প্রসূতি মায়েদের হাসপাতালে নিতে দুর্ভোগের শেষ থাকে না এলাকাবাসীর। দুই ঘণ্টা লাগে নদী পাড়ি দিতে। নেই কোনো ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স। ভরসা কেবল ট্রলার ও নৌকা। দীর্ঘ নদীপথ পাড়ি দিয়ে উপজেলা বা জেলা সদরের হাসপাতালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক সময় পথেই নিভে যায় জীবন প্রদীপ। এই অবস্থায় দ্রুত অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স চালুর দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। 

এ ছাড়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগের আঘাতে বিপর্যস্ত এ জনপদ। বেড়িবাঁধ না থাকায় ঝড়-বন্যা বা বৃষ্টিতেই শুধু নয়, জোয়ারের পানিতেও প্লাবিত হয় এই অঞ্চল। ভেসে যায় পুকুর-ঘের। নষ্ট হয় খেতের ফসল।

শনিরঝোড় গ্রামের অশীতিপর বৃদ্ধ অমূল্য মন্ডল। তিনি বলেন, সরকার এসেছে, সরকার বদলেছে- কিন্তু আমাদের ইউনিয়নের মানুষের ভাগ্য বদলায়নি। রাস্তা-ঘাট, শিক্ষা, চিকিৎসাসেবাসহ সবধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত আমরা।

শিক্ষার্থী হিমেল হাওলাদার, শায়লা আক্তার, তনু মন্ডলসহ অনেকেই ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, বৃষ্টি হলে কাঁচা রাস্তায় কাদা-পানি জমে থাকে। আমরা স্কুল-মাদরাসায় যেতে পারি না। দেশে কত রাস্তা ঠিক হয়, এক রাস্তা হাজারবারও ঠিক হয়। আমাদের তো রাস্তাই নেই।

স্থানীয় মো. মাসুদ শিকদার ও আমিরুল ইসলাম বলেন, আমরা বিচ্ছিন্ন একটি এলাকায় বসবাস করি। রাস্তা-ঘাট নেই। ভালো স্কুল-কলেজ নেই। নেই হাসপাতাল ও নিত্য প্রয়োজনীয় বাজারের জন্য আধুনিক মার্কেট। এরপরও বাপ-দাদা এখানে বসবাস করেছেন, তাই আমরাও আছি। 

ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা আরও বলেন, প্রসূতি মা বা গুরুতর অসুস্থদের হাসপাতালে নেওয়া যে কত কঠিন তা বলে বোঝানো যাবে না। সরকারের কাছে দ্রুত কাঁচা রাস্তা উন্নয়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, নদীপথে শহর থেকে মালামাল এনে বিক্রি করি। একদিকে ঝুঁকি অন্যদিকে খরচ। সময়ও লাগে বেশি। তারপর আবার ইউনিয়নজুড়ে কাঁচা রাস্তা। বর্ষায় মালামাল আনা যায় না। মহাবিপদে আছি ভাই।

প্রায় তিন যুগ মাছ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কামাল ফকির। তিনি বলেন, ধারদেনা করে ব্যবসা করি। নদীপথে বেশি সময় লাগে মাছ আনতে। অনেক সময় পথেই মাছ-পোনা মারা যায়। আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয় আমাদের। তখন সংসার চালাব, ব্যবসা করব নাকি মানুষের দেনা শোধ করব। আমাদের মতো এত অবহেলিত এলাকা আর নেই বাগেরহাটে।

ফুলহাতা গ্রামের ঘের ব্যবসায়ী মো. রাকিব খান জানান, এই এলাকার নদী খালে বছরের বেশিরভাগ সময় লবণ পানি থাকায় এখানে ধানসহ তেমন কোনো ফসল হয় না। ফলে বেশিরভাগ মানুষই মাছ চাষ ও নদী খালে মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু জোয়ারের পানিতে এবং প্রাকৃতিক দূর্যোগে বছরে একাধিক বার মাছের ঘের ভেসে যায়।

এখানে যাতায়াতের একমাত্র বাহন ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেল চালক মাসুম হাওলাদার বলেন, আমাদের পুরো ইউনিয়নজুড়েই রয়েছে মাটির রাস্তা। কোথাও অল্প অল্প ইটের সোলিং আছে। কিছু মোটরসাইকেল চলে। তাও আবার সব রাস্তা দিয়ে চলা যায় না। আর বৃষ্টি হলে তো বের হওয়ার কোনো উপায় থাকে না। বছরে ৬ মাস আমাদের বেকার বসে থাকতে হয়। জানি না এই অবস্থা থেকে কোনো দিন মুক্তি পাব কি না।

বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ বৈদ্য বলেন, ৩৫/২ পোল্ডারের আওতায় মোরেলগঞ্জের সন্ন্যাসী থেকে রামপাল হয়ে মোংলার জয়মনির ঘোল পর্যন্ত প্রায় ৯৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের একটি প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আশা করি প্রকল্পটি অনুমোদন হলে ওই অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ কমবে। পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটবে বলে দাবি করেন তিনি।

বাগেরহাট-৪ (মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাড. আমিরুল আলম মিলন বলেন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে মোরেলগঞ্জবাসীর দুর্দশা রোধকল্পে বারুইখালি-মোংলা বেড়িবাঁধ, বহরবুনিয়া থেকে মোংলা পর্যন্ত নদীর পাশে গাইড ওয়াল দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এই প্রকল্প দুটি বাস্তবায়ন হলে উপজেলার মানুষের দুঃখ লাঘব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

তানজীম আহমেদ/এসপি