‘হৃদয় দিয়ে হোক হৃদরোগের প্রতিরোধ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগ বেলা সাড়ে ১১টায় একটি কক্ষে পালন করছিল ‘বিশ্ব হার্ট দিবস’। ভেতরে যখন উৎসব চলছিল, সেই কক্ষের বাইরে তখন বসে কাঁদছিলেন মোসাম্মৎ রানী। পোস্ট সিসিইউতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে তার বাবা আব্দুল খালেক হাসপাতালে ভর্তি।

বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার চাঁদপাপশা ইউনিয়ন থেকে এসেছেন রানী। ভাই-বোনের মধ্যে রানী সবার বড়। আয়ক্ষম একমাত্র ব্যক্তি বাবা শয্যাশায়ী। তাই সংসারের চাকা গেছে বন্ধ হয়ে। কিন্তু একদিকে বাবা, আরেক দিকে সংসার নিয়ে বিপাকে আছে তার পরিবার।

চিকিৎসকরা জানান, রানীর বাবার হার্টে ব্লক ধরা পড়েছে এবং ফুসফুসে পানি জমেছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য তার বাবাকে ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কারণ, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়ার মতো ব্যবস্থা এই হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগে নেই। কিন্তু সামর্থ্য না থাকায় তার বাবাকে ঢাকায় নিতে পারছেন না রানী। ফলে নিরুপায় হয়ে বসে বসে কাঁদছেন রানী।

রানী বলেন, এই হাসপাতালে চিকিৎসা না পেলে হয়তো আব্বা মারা যাবেন। তারপর তার লাশটি নিয়ে যেতে হবে বাড়িতে। বর্তমানে বাবাকে বাঁচাতে হাসপাতালের অন্যান্য রোগীর স্বজনদের হাত-পায়ে ধরে সাহায্য চাইছেন বলে জানান।

আরেক রোগী ওয়াহেদ বুধবার সকালে এসেছেন একজন চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও দেখা করতে পারছিলেন না। ক্ষোভ প্রকাশ করে ওয়াহেদ বলেন, দিবস এলে নামকাওয়াস্তে হার্ট দিবস পালন করা হয়। অথচ শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বরিশাল বিভাগের হৃদরোগীদের চিকিৎসার একমাত্র হাসপাতাল। এশিয়ার সর্ববৃহৎ এই হাসপাতালে একটি এনজিওগ্রামের মেশিন আনা হয়েছিল। ষড়যন্ত্রকারীদের দৌরাত্ম্য ও সিন্ডিকেটের কারণে মেশিনটি নষ্ট করে রাখা হয়েছে। যাতে মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে ছুটে যায়।

সাবেক এই ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের দাবি, এই হাসপাতালের সিসিইউ এবং কার্ডিয়াক সেকশন চিকিৎসার জন্য উন্নত করা হোক। চিকিৎসা ছাড়া যেন কোনো রোগীকে ফেরত যেতে না হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি আর অদক্ষতার তো আর সীমা নেই। আমি মনে করি ‘ফাটাকেস্ট’র মতো দুর্নীতি দমনে কাজ করে রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা উচিত। নয়তো এসব হার্ট দিবস লোক দেখানো ছাড়া আর কিছুই না।

শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্তদের বড় ধরনের চিকিৎসাসেবা দেওয়া যায় না অপ্রতুলতার কারণে। বিষয়টি স্বীকারও করেছেন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. জাকির হোসেন। তিনি বলেন, কার্ডিলজি বিভাগে মোট শয্যাসংখ্যা ১০টি। কিন্তু এখানে প্রতিদিন ৬৫ জনের ওপর রোগী ভর্তি হন। ফলে হিমশিম খেতে হয় রোগীর চিকিৎসায়।

তিনি বলেন, কার্ডিওলজি বিভাগে অনেক কিছুই নেই, যা একজন রোগীকে বাঁচাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগ নেই। এটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি আমাদের থাকলেও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে চালু করা যাচ্ছে না। শিশু হৃদরোগ কিন্তু একটি আলাদা বিভাগ। অথচ তা নেই আমাদের হাসপাতালে। হার্ট ফেইলর ইউনিট করা দরকার। কারণ এখন যারা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়, তাদের মধ্যের বিশাল একটি অংশ হার্ট ফেইল করে। তা ছাড়া সন্তান জন্ম দেওয়ার পরে অনেক মা হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তাদের চিকিৎসার জন্য আলাদা ইউনিট দরকার।

এই চিকিৎসক বলেন, অনেক অভাব থাকলেও হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের চিকিৎসক, নার্স সবাই মিলে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।

দক্ষিণাঞ্চলে হৃদরোগীর পরিসংখ্যান বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে না থাকলেও শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে জানা গেল, বিগত কয়েক বছরে কতজন চিকিৎসা নিতে এসে ভর্তি হয়েছেন। ২০১৮ সালে কার্ডিওলজি বিভাগের সিসিইউতে ভর্তি হন ৭ হাজার ৮৪৭ জন। এই রোগীর মধ্য থেকে ৬ হাজার ৫৭৬ জন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন, ৭৩৭ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়েছে। আর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন ৫৩৪ জন। গড় হিসাবে সুস্থ হন ৮৩ দশমিক ৮০ শতাংশ, স্থানান্তর করা হয় ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং মৃত্যুবরণ করেন ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।

২০১৯ সালে রোগী ভর্তি হন ৮ হাজার ৪২১ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৬ হাজার ৭৭৪ জন। উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে ৯৬১ জন এবং মারা যান ৬৮৬ জন।

২০২০ সালে কার্ডিওলজি বিভাগে মোট চিকিৎসা নেন ৬ হাজার ৮৩৩ জন। এর মধ্যে থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্যত্র স্থানান্তর করা হয় ২৪১ জন, মৃত্যুবরণ করেন ৬৪৩ জন এবং সুস্থ হন ৫ হাজার ৯৪৯ জন।

সর্বশেষ ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ৬ হাজার ৭১৮ জন। তাদের মধ্যে ৬৬৮ জন মৃত্যুবরণ করেন।

দায়িত্বরত চিকিৎসকরা জানান, প্রতিবছরই হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ব্যক্তি সচেতনতা যেমন বৃদ্ধি করতে হবে, তেমনি সুচিকিৎসার ওপর জোর দিতে হবে।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. বাসুদেব কুমার দাস বলেন, হৃদরোগের অন্যতম কারণ আমাদের খাদ্যাভ্যাস, বদঅভ্যাস এবং জীবনযাপনের ধরন। হার্ট ভালো রাখতে চর্বিযুক্ত, মিষ্টিজাতীয় খাবার অবশ্যই পরিহার করতে হবে। বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের ফাস্টফুডের দিকে বেশি ঝোঁক। ফাস্ট ফুড অবশ্যই পরিহার করতে হবে। এতে হার্ট নষ্ট হয়।

স্বাস্থ্য পরিচালক বলেন, বদঅভ্যাসের মধ্যে তামাক-জাতীয়, অ্যালকোহল অবশ্যই পরিহার করতে হবে। এ ছাড়া জীবনযাপনের ক্ষেত্রে এখন বৈশ্বিক মহামারি চলছে। এ অবস্থায় অনেকেই বাসায় বসে থাকেন। এতে হার্টের ক্ষতি হয়। আপনাকে অবশ্যই নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্যে প্রতিদিন অন্তত দুই বেলা ৩০ মিনিট করে হাঁটতে হবে।

ডা. বাসুদেব কুমার দাস বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য সরকারিভাবে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কার্ডিওলজি বিভাগ চলু রয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারিভাবে হার্ট ফাউন্ডেশন কাজ করছে। আমরা চেষ্টা করছি, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেসব চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই, যে কারণে রোগীদের ঢাকামুখী হতে হয়। সেই সরঞ্জামগুলো এনে চালু করে হাসপাতালটির কার্ডিওলজি বিভাগের সক্ষমতা বাড়ানো দরকার।

এনএ