প্রতিবন্ধী রজ্জব আলীর চাওয়া একটি ঘর
ব্যাটারিচালিত তিন চাকার ছোট একটি রিকশায় করে আতর বেচেন রজ্জব আলী
জন্মের পর থেকেই মা-বাবার দুশ্চিন্তা ছিল তাদের ছেলে বড় হয়ে কীভাবে চলবে। মা-বাবার আদরের সন্তান রজ্জব আলী যখন বুঝতে শেখেন, তখন তাকে দরজির কাজ শেখান। সেই থেকে শুরু কর্মজীবন। কিন্তু শূন্যবাত কোড় জ্বরে তার দুটি পা অচল হয়ে গেছে। জীবিকার তাগিদে দরজি দোকানের পরে একটি নার্সারিও করেছিলেন। কিন্তু কোনো কিছুই সফল করে উঠতে পারেননি।
মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের পাড়িল গ্রামের মৃত মুকছেদ আলীর সন্তান রজ্জব আলী। স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে তার সংসারজীবন। বেশ কয়েক বছর আগে তিন ছেলে মেয়ের বিয়েও দিয়েছেন। পরিবারে আর্থিক দৈন্যতার কারণে এখন তিনি বাজারে বাজারে ঘুরে আতর বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
বিজ্ঞাপন
রজ্জব আলী লেখাপড়া করেছেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। তবে প্রতিবন্ধী হলেও হয়ে উঠেছেন আত্মনির্ভরশীল। কখনো ভিক্ষাবৃত্তি বা অন্যের কাছে হাত পাতেননি তিনি। বয়স ষাটের কোঠায়। দুটি পা অচল থাকায় চলাচল করতে হয় ব্যাটারিচালিত তিন চাকার ছোট একটি রিকশায় করে। এই বয়সেও অন্যের দুয়ারে ধরনা না দিয়ে রিকশাযোগে স্থানীয়সহ আশপাশের বাজারে আতর বিক্রি করে দিনাতিপাত করছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, পরনে হালকা আকাশি রঙের পাঞ্জাবির ওপর মেগি হাতার সোয়েটার পরিহিত। মাথায় একটি সাদা রঙের টুপি। গাড়ির সামনের বাক্সে সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে আতরের প্যাকেট। সিংগাইর উপজেলার পাড়িল বাজারে বিভিন্ন ধরনের আতর, তসবিহ বিক্রি করছেন রজ্জব আলী। প্রতিবন্ধী হওয়ার পরেও কর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করেন বলে তার কাছ থেকে আতরও কেনেন অনেকে। তার ছোট গাড়ি চারপাশে ক্রেতার ভিড় দেখা যায়। বর্তমানে তিনি সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী কার্ডের মাধ্যমে প্রতি মাসে সাত শ টাকা পান। এ ছাড়া অন্য কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পান না তিনি।
বিজ্ঞাপন
প্রতিবন্ধী রজ্জব আলীর সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় আব্দুস ছাত্তার বলেন, ছোটবেলা থেকেই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী রজ্জব আলী। আমাদের সঙ্গে লেখাপড়াও করেছে। প্রতিবন্ধী হলেও বসে না থেকে দরজির কাজ শিখেছে। ছোট থেকে সে এমন, বসে বসে খাবে না আর কারও কাছে হাতও পাতবে না। নিজে কর্ম করে জীবিকা নিবারণ করার মনোবল ও মনবাসনা ছোট থেকেই ছিল রজ্জবের। দরজির কাজের পরে নার্সারি করেছিল। কিন্তু সবকিছু হারিয়ে এখন আতর বিক্রি করে চলছে। তার প্রতি স্থানীয়দের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব মনোভাব রয়েছে এবং মানুষ হিসেবে অনেক ভালো। সরকারের কাছে সহায়সম্বলহীন রজ্জবের জন্য মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে একটি ঘরে করে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
একই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা শরিফ বলেন, আমার জানামতে তিনি খুবই ভালো মানুষ। তিনি কর্ম করে খাচ্ছে এবং কারও কাছে হাত পাততে আমি দেখিনি। আমার জানামতে, তার নিজস্ব ঘরবাড়ি নেই। বর্তমান সরকার বিভিন্ন এলাকায় অসহায়দের ঘরবাড়ি, জমি দিতাছে। সরকারের কাছে দাবি জানাই, ওনাকে যেন সরকারিভাবে একটি ঘর দেয়।
রজ্জব আলীর চাচা নুরুল ইসলাম বলেন, আমি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় থেকে তাকে (রজ্জব আলী) চিনি। তখন থেকেই দেখে আসছি তার এই অবস্থা। তিনি ভিটা-বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন অনেক আগেই। প্রতিবন্ধী হলেও নিজের প্রতি তার অনেক আত্মবিশ্বাস রয়েছে। এখন আতর, তসবিহ বিক্রি করে জীবিকা করেন। তাকে যদি একটি ভিটা-বাড়ি বা চলার মতো কিছু করে দেওয়া যায়, তাহলে অনেক ভালো হয়। সরকারের কাছে তিনি রজ্জব আলীর জন্য একটি ঘরের দাবি জানান।
পাড়িল গ্রামের ঈমামপাড়ার বাসিন্দা বরকত আলী বলেন, অঙ্গহীন হয়েও তিনি (রজ্জব আলী) আমাদের বাজারসহ আশপাশের বাজারে ১৫ বছর ধরে আতর বিক্রি করে জীবন বাঁচাইতাছে। অন্যের নিকট হাত পেয়ে কিছু নেওয়ার চেয়ে ব্যবসা করা ভালো। তাই তিনি ব্যবসা করছেন। আমিও মাঝেমধ্যে তার কাছ থেকে আতর কিনি।
জন্মের পর থেকে জীবন-সংসারে কীভাবে সংগ্রাম করে টিকে আছেন? জানতে চাইলে প্রতিবন্ধী রজ্জব আলী ঢাকা পোস্টকে জানান, ছোটবেলা থেকেই আমার এই অবস্থা। শূন্যবাত কোড় জ্বরে আমার দুটি পা অচল হয়ে গেছে। সামান্য লেখাপড়া করছি। প্রতিবন্ধী হওয়ায় মা-বাবার বাড়তি চিন্তাও ছিল আমাকে নিয়ে। মা-বাবার চিন্তা ছিল বড় হলে কেমনে চলব আমি। তাই আমাকে দরজি কাজ শেখান।
তিনি বলেন, দরজির কাজ শেখার পরে একটি দোকানও দিয়েছিলাম। কয়েকজন কর্মচারীও কাজ করত ওই দোকানে। বেশ ভালোই চলছিল। তবে ভাগ্যটা খুবই নরম, হঠাৎ করেই ভেঙে যায়। তখন খুব অসহায় হয়ে পড়লাম। নিজের বলতে যা ছিল, সব বিক্রি করে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়লাম। স্ত্রী, ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে খুব বিপাকে পড়ে গেলাম। এখন চলার মতো কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না।
রজ্জব আলী বলেন, স্বাভাবিক মানুষের মতো চলতে পারি না। মাটি কাটতে, বোঝা নিতে এমনকি রিকশাও চালাতে পারুম না। একটি দিন রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতেছি কী করব, কীভাবে সংসার চলবে। হাঠাৎ মনে হলো, আমার নবীজির (সা.) শিক্ষা, করো না ভিক্ষা, মেহনত করো, পরিশ্রম করো, হাত পাইত না, আল্লাহ্ চালাইব। ওনার (নবীজি) কথা বিশ্বাস করে আমি আতরের ব্যবসা শুরু করলাম। আতর বিক্রি করে ডালভাত খেয়ে কোনোমতে চলতাছি।
এই ধরনের মানসিকতার মানুষগুলো আমাদের সমাজ থেকে কমে যাচ্ছে। রজ্জব আলী প্রতিবন্ধী হয়েও আত্মনির্ভরশীল হিসেবে বেঁচে থাকতে চান। এ কারণে আমি তাকে স্যালুট জানাই। প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও কারও সাহায্য না নিয়ে নিজে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে চান। সে জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিভিন্ন ধরনের আয়বর্ধনমূলক ও সামাজিক নিরাপত্তার আওয়তায় আমরা তাকে সহযোগিতা করতে পারব।
মো. মনিরুজ্জামান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক)
তিনি বলেন, আমি তো অসহায়, সর্বহারা মানুষ। আমার ঘর নাই, বাড়ি নাই। জায়গা-জমিও নাই। আতরের ব্যবসা করি। আমি কারও কাছে নিচু নই, আমি দুই টাকা কাউকে দিতে পারি কিন্তু কারও কাছ থেকে হাত পেতে দুই টাকা নেই না। এখন পাড়িল বাজার, চারিগ্রাম, জামশা, বরুন্ডিসহ সিংগাইর উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে আতর বিক্রি করি। বাজারে প্রতিদিন তিন থেকে চার শ টাকার মতো বিক্রি হয়। হাটের দিন পাঁচ থেকে ছয় শ টাকা বিক্রি করতে পারি।
আতরের ব্যবসায় কেমন চলছে? জানতে চাইলে রজ্জব আলী বলেন, করোনার কারণে আমার আতরের ব্যবসায় ভাটা পড়েছে। গত কোরবানির ঈদেও ভলো ব্যবসা করতে পারি নাই। গেলা বন্যায় ব্যবসা করতে পারি নাই পানির জন্য। এ বছর আমি খুব সমস্যার মধ্যে আছি। আমার অনেক মালপত্র ছিল টকার অভাবে নতুন করে মালপত্রও আনতে পারছি না। অর্থের অভাবে আমার আতরের ব্যবসা বন্ধের পথে। আমি ঢাকার বিহারিদের কাছ থেকে আতর আনি। তাদের মালামালের ন্যায্যমূল্যই দিতে হয়। তবে তারা আমাকে বোনাস দেয় কারণ মালামাল আনতে দু-চারজন লোক নিয়া যাই। ওরা আমাকে অনেক ইজ্জত-সম্মানও করে। পয়জন, কাঁচাবেলি, ম্যাগনে, দরবার ও লায়লা নামের আতর বাজারে বেশি বিক্রি হয়।
আতরের ব্যবসা সচল করতে কত টাকার প্রয়োজন? এ বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যবসায় বিনিয়োগের তো শেষ নাই। তবে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা হলে মালামালগুলো আনতে পারব। তাতে আমি আবারও আতরের ব্যবসা করে কোনোমতে চলতে পারব। কোথায় টাকা পাব? মালপত্রও নাই। বর্তমানে আমি খুব কষ্টে আছি, খবু অসহায় হয়ে পড়েছি।
সরকারে কাছে কোনো চাওয়া-পাওয়া আছে কি না, জানতে চাইলে রজ্জব আলী বলেন, অনক সময় পত্রপত্রিকায় দেখি আর টেলিভিশনে শুনি, সরকার অসহায় মানুষকে বিনা মূল্যে ঘর-বাড়ি, জয়গা দেয়। সরকারের তরফ থেকে যদি একটি বাড়ি বা ঘর অনুদান পাইতাম। আল্লাহপাক কত দিন বাঁচায়ে রাখব, তা তো জানি না। তয় জীবনে বাকি দিনগুলি একটু আরাম-আয়েশে থাকতে পারতাম মনে একটা ভাব নিয়া। আমার খুব ভালো লাগত বলে জানান জীবন যুদ্ধে হার না মানা প্রতিবন্ধী রজ্জব আলী।
এ বিষয়ে মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মনিরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে জানান, এই ধরনের মানসিকতার মানুষগুলো আমাদের সমাজ থেকে কমে যাচ্ছে। রজ্জব আলী প্রতিবন্ধী হয়েও আত্মনির্ভরশীল হিসেবে বেঁচে থাকতে চান। এ কারণে আমি তাকে স্যালুট জানাই। প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও কারও সাহায্য না নিয়ে নিজে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে চান। সে জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিভিন্ন ধরনের আয়বর্ধনমূলক ও সামাজিক নিরাপত্তার আওয়তায় আমরা তাকে সহযোগিতা করতে পারব।
মুজিব বর্ষে সারাদেশে গৃহহীনদের মাঝে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে দুর্যোগসহনীয় একটি ঘর দেওয়া হবে। তিনি আমাদের বরাবর আবেদন করলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি অথবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে তার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে জমিসহ ঘরের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান তিনি।
এনএ