শেরপুর সদর উপজেলার ভাতশালা ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নে রয়েছে কয়েকটি কুমার পরিবারের বসবাস। তারা মাটির জিনিসপত্র তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করতেন। কিন্তু করোনা ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে আদি এ পেশা। তাই মৃৎশিল্পের ওপর কুমারদের দিন দিন আগ্রহ কমছে। 

সরেজমিনে সদর উপজেলার কুমারপাড়ায় দেখা যায়, সেখানে সুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। মাত্র ১৫-২০টি পরিবার টিকিয়ে রেখেছে বাপ-দাদার এ পেশাটিকে। মাটির জিনিসপত্র বিক্রি শূন্যের কোঠায় নেমে আসায় সংসার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে হতদরিদ্র এই পরিবারগুলো। অভাবে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে তাদের কপালে। অথচ এক সময় বাংলার হারিয়ে যাওয়া এসব মাটির জিনিসপত্র ছাড়া গৃহস্থলির কাজকর্ম করা ছিল অসম্ভব।

বাড়ির উঠানে খোলা আকাশের নিচে কাজ করছেন ষাটোর্ধ্ব শ্রীমতী মিলন রানী পাল। আক্ষেপ করে বলেন, সেই দিন কই গেল? কত মাটির জিনিস এই দুই হাত দিয়ে বানিয়েছি। আজ সময়ের পরিবর্তনে সব হারিয়ে গেছে। আগে আমি ছোটদের জন্য হরেক রকম পুতুল বানাতাম। আমার মাটির পুতুলের কাজ দেখতে সুদূর ঢাকা থেকে লোকজন আসতে। ছবি ও ভিডিও করে নিয়ে যেত। 

একবার ঢাকা থেকে এক নারী লেখক এসেছিলেন শেরপুরে। তার নাম সামিনা নাফিজ। তিনি আমাকে নিয়ে একটা বই বের করেছিলেন। বইয়ের নাম পুতুল : বাংলার প্রাণ প্রতিমা। ওই নারী লেখিকা আমাকে পাঁচ দিনের জন্য বরিশালে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন দুর্গাপূজা চলছিল। সেখানে আমি মাটি দিয়ে পুজার দুফতি, পুজার হাড়ি, ছোট পুতুল বানিয়েছিলাম। যা দেখে বরিশালের লোকজন খুশি হয়ে আমাকে পাঁচ হাজার টাকা বকশিস দিয়েছিলেন।

কুমারপাড়ায় সাজিয়ে রাখা মাটির ব্যাংক প্রকারভেদে পাইকারি ১০-১৫ টাকা, পাতিলের ঢাকনা ১০ টাকা, গরুর খাবারের চারি ১০০-১৫০ টাকা, দইয়ের পাতিল ৬-১০ টাকা, জলকাঁদা ৫-১০ টাকা, ঢাকনা ৬-৮ টাকা, মুছি ৫০ পয়সা, মাটির প্রদীপ রাখার ধূপতি ৩০ টাকা ও পূজার হাড়ি ৫০ টাকা।

মৃৎশিল্পের জাদুকর যুগল চন্দ্র পাল বলেন, আমার বংশের তিন পুরুষের হাল ধরে আছি। আমার দুই ছেলে মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করছে। তারাই আমার বংশের শেষ ভরসা। আমরা না থাকলে মানুষ একসময় আমাদের খুঁজবে। কিন্তু তখন মাটির জিনিসপত্র বানানোর লোক খুঁজে পাবে না।

শিল্পী নামে একজন বলেন, মাটি খরচ, লাকড়ি পুড়ানো সব মিলে লাভ কম। তবুও আদি পেশা হওয়ায় এখনও হাল ধরে আছি। শুধু বাংলা নববর্ষ এলে শহরের ধনীদের আমাদের কথা মনে পড়ে। বিশেষ করে পান্তা-ইলিশে আমাদের মাটির থালা দরকার হয়। তখন কিছু টাকা আয় করা যায়।

ভানু বলেন, পৃথিবীর অনেক পেশা অন্যরা শিখে তারাও চোষ্টা করে। কিন্তু আমাদের কুমার পেশা কেউ নিতে চায় না। আমরা বিল থেকে মাটি সংগ্রহ করি। তারপর সেটি গাড়িতে করে বাসায় আনি। এরপর পা দিয়ে দীর্ঘক্ষণ মাড়িয়ে উপযুক্ত করি। পরিশ্রম অনুযায়ী দাম পাই না।

হারাধন পাল বলেন, আমাদের সন্তানরা মৃৎশিল্পের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। কারণ তারা জানে এই পেশায় আয় কম, পরিশ্রম বেশি। তাই তারা লেখাপড়া করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। এভাবে চললে এক সময় শেরপুর জেলা থেকে কুমার শিল্প হারিয়ে যাবে। সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন আমাদের দিকে নজর দিলে আমরা আরও ভালো কিছু করতে পারতাম।

শেরপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ ফিরোজ আল মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি পালপাড়ার স্থানীয় চেয়ারম্যানকে বলেছি। সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা পেলে তাদের পৌঁছে দেওয়া হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যংক অল্প সুদে ঋণ দেয়। পালপাড়ার কেউ যদি সেই ক্ষুদ্র ঋণ নিতে চায় তাহলে উপজেলা প্রশাসন তাদের সহযোগিতা করবে।

এসপি