মহামারি করোনাভাইরাসে প্রায় দেড় বছর বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ সময় পাবনা সদর উপজেলার সাদুল্লাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩২ শতাংশ শিক্ষার্থীর ঝরে পড়েছে বলে জানা গেছে। 

সোমবার (০৪ অক্টোবর) দুপুরে বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক শরিফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঝরে যাওয়া এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার এবং ছেলেরা বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও তাদের স্কুলমুখী করা যাচ্ছে না।

বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের মার্চ মাসে স্কুলটি বন্ধ হওয়ার সময় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৫৯৫ জন। বর্তমানে ক্লাস করছে ৪০০ শিক্ষার্থী। দশম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৬১। এদের মধ্যে এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন করেছিল ৪৮ জন। চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করেছিল ৩৯ জন শিক্ষার্থী। অষ্টম শ্রেণিতেও একই অবস্থা বলে জানা গেছে। ৯৬ জন শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন করে ফরম পূরণ করেছিল ৪১ জন। 

এদিকে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার পর্যবেক্ষণ করে দেখন পান, ৩২ শতাংশ শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হচ্ছে না। পরে স্কুল কর্তৃপক্ষ বাড়িতে বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার ও ছেলেরা বিভিন্ন কাজে যোগ দিয়েছে।

বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র রাফসান শাওন জানায়, দীর্ঘ দিন স্কুল বন্ধ থাকায় তার সহপাঠীদের অনেকেই শ্রমিকের কাজ করছে, কেউবা রাজমিস্ত্রি-কাঠমিস্ত্রির কাজ বেছে নিয়েছে। এখন কাজের মধ্যে থেকে তারা আর বিদ্যালয়ে আসতে চাচ্ছে না। আমরা তাদের বাড়িতে গিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালে তারা বিষয়টি এড়িয়ে যায়।

একই শ্রেণির শিক্ষার্থী অর্ণব হাসান বলে, সহপাঠীদের অনেকে স্কুলে আসে না। শুনছি তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। করোনাকালে ২-৩ বান্ধবীর বিয়ের দাওয়াতও খেয়েছি। প্রায় ১৫-২০ জনের বিয়ে হয়ে গেছে। বিষয়টি আমরা মেনে নিতে পারছি না। 

নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী বৈশাখী আক্তার জানায়, করোনার আগে স্কুলে অনেক বান্ধবী ছিল। টিফিনের সময় কত আড্ডা মজা করতাম। তাদের অনেকেই আজ স্কুলে আসে না। 

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুুস সামাদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা। দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকায় পরিবারগুলো সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। স্কুল খোলার অনিশ্চয়তায় অনেকে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। আবার অনেকে জীবন-জীবিকার তাগিদে ছেলেসন্তানদের ঢাকায় বার অন্যকোনো কাজে যোগদান করিয়েছেন। সব মিলে স্কুলের পড়ার আগ্রহ অনেক শিক্ষার্থী হারিয়ে ফেলেছে। বিবাহিত মেয়েদের অনেকেই পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ফরম পূরণ করলেও পরীক্ষা দিতে রাজি হচ্ছে না।

ওই বিদ্যালয়ের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিরুজ্জামান খান জানান, দারিদ্র্যের কারণেই অনেক পরিবার সন্তানদের অন্য কাজে লাগিয়েছেন। আবার অনেক অভিভাবক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। দু-একটি বিয়ের খবর জানার পর স্কুলের শিক্ষকরা গিয়ে বন্ধ করেছে। পরে কিছু বিয়ে গোপনে হয়। এ কারণে আমাদের আর কিছু করার ছিল না। ঝরে যাওয়া শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করার জন্য চেষ্টা করা হলেও তারা বিদ্যালয়ে আসছে না। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে মিটিং ডেকে এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে।

পাবনা জেলা শিক্ষা অফিসার এসএম মোসলেম উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুধু সাদুল্লাপুর উচ্চ বিদ্যালয় নয়, জেলার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এ অবস্থা দেখা যাচ্ছে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের তালিকা তৈরি করতে বিদ্যালয়গুলোকে লিখিত নির্দেশনা দিয়েছি। স্কুল থেকে তালিকা পাঠালেই প্রকৃত সংখ্যা জানা যাবে। আগামী ২০ অক্টোবরের মধ্যে বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রমসহ ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের নামের তালিকা সংশ্লিষ্ট শিক্ষা অফিসে জমা দিতে বিদ্যালয়গুলোতে চিঠি পোস্ট করেছি। আশা করি ২২-২৩ তারিখের মধ্যে আমরা পূর্ণাঙ্গ নামের তালিকা আপনাদের হাতে দিতে পারব।

পাবনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আফরোজা আখতার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়গুলো শিক্ষা অফিস আমাকে জানিয়েছে। বিদ্যালয়ে কিছু শিক্ষার্থীদের না আসার বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান চলছে। কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি নিয়ে আমরা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছি। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

রাকিব হাসনাত/এসপি