টাঙ্গাইলে আগরগাছ লাগিয়ে এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন বাগান মালিকরা। নির্দিষ্ট সময় পার হলেও আগরগাছ কেটে প্রসেসিংয়ের উদ্যোগ না নেওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। তাদের কাছে আগরগাছ এখন গলার কাটা। তবে বনবিভাগ বলছে, আগর প্রসেসিং করতে এখনও কমপক্ষে পাঁচ বছর সময় লাগবে।

সরেজমিনে জেলার মধুপুর গড় ও ঘাটাইল পাহাড়ের বেশ কয়েকটি এলাকায় দেখা গেছে, সারি সারিভাবে আগরগাছ লাগানো হয়েছে। তবে এখনও গাছগুলো পরিপক্ক হয়নি। রোপণের সময় বন বিভাগ জানিয়েছিল, আগর চারা লাগানোর ১০ বছরের মধ্যে এটি প্রসেসিংয়ের পর কষ থেকে সুগন্ধি তৈরি করা হবে। যার দাম লাখ লাখ টাকা। 

জানা গেছে, আগর মূলত একটি গাছের নাম। আগর শব্দের আভিধানিক অর্থ উৎকৃষ্ট বা সুগন্ধবিশিষ্ট কাঠ। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বনবিভাগ আগর বনায়নের প্রকল্প হাতে নেয়। সেসময় মধুপুর গড়ে এবং ঘাটাইলের পাহাড়ি অঞ্চলে বেশ কিছু এলাকায় আগরের বাগান করা হয়। 

সে সময় বলা হয়েছিল, আগর চাষ সবচেয়ে লাভজনক। এর কাঠ বিশেষ কায়দায় খণ্ডবিখণ্ড ও প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে এর নির্যাস বাষ্পীভবন ও শীতলীকরণের মাধ্যমে দামি সুগন্ধি আতর, ওষুধ, সাবান, শ্যাম্পু, পারফিউম এবং অবশিষ্ট অংশ আগরবাতি বানানোর কাজে ব্যবহৃত হবে। এভাবে আগর চাষে ভাগ্য বদল হবে।

এদিকে জেলায় আগরগাছ প্রসেসিংয়ের জন্য কোনো কারখানা নেই। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় কারখানা থাকলেও ফরেস্ট ট্রানজিট রুলের কারণে সেখানে গাছ সরবরাহ করা কঠিন। তাছাড়া গাছের বয়স ১২-১৩ বছর হলেও বনবিভাগ বাগানের আগরগাছে পেরেক মারার কোনো কাজ করেনি।

ঘাটাইলের সাঘরদিঘী রেঞ্জের কামালপুর গ্রামের কামরুল হাসান। তিনি দেড় একর পৈতৃক সম্পত্তি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় খাস হওয়ার ভয়ে এক রকম বাধ্য হয়েই আগরগাছের বাগান করেন। যদিও বাগান করতে তখন তাকে লাখ লাখ টাকার লাভ দেখানো হয়। কিন্তু লাভতো দূরের কথা আগর এখন গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার।

কামরুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, জোর করেই আমাদের দিয়ে তখন আগরের বনায়ন করা হয়েছিল। আগরগাছ অনেক মূল্যবান গাছ। বনায়ন করলে তাড়াতাড়ি ধনী হওয়া যাবে। ১১ বছরের মধ্যে গাছগুলোতে নম্বর দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৩-১৪ বছরেও গাছে নম্বর ফেলানো হচ্ছে না। এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে বনবিভাগকে বার বার বলা হয়েছে। 

তিনি বলেন, দেড় একর জায়গায় আগরগাছ লাগিয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এটি থেকে কোনো আয় হবে কি না সন্দেহ আছে। শুধু আমি না এলাকার অনেকেই আগরগাছ লাগিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগরগাছ সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। তবে বনবিভাগ জানিয়েছিল, এই গাছ থেকে এক ধরনের সুগন্ধি বের হবে। যা অনেক মূল্যবান। মৌলভীবাজারের এক কোম্পানির কাছে আগরগাছ বিক্রি করা হবে কিন্তু সেটার কোনো উদ্যোগ এখনও নেওয়া হয়নি। এখন পর্যন্ত গাছ থেকে কোনো কষ বের হচ্ছে না।

ঘাটাইলের কামালপুর গ্রামের আব্দুস সামাদ বলেন, চালায় (জায়গায়) আগর বাগান করতে হবে, না হলে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে এমন কথা বলে বনবিভাগ তখন আগরের বনায়ন করতে বাধ্য করে। তারা লাখ লাখ টাকার স্বপ্ন দেখায় আমাদের। আগরগাছ থেকে কষ বের হবে। কষ থেকে সুগন্ধি হবে। যা অনেক মূল্যবান। কিন্তু গাছের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। এমনকি আগরগাছ দেখতে কোনো কর্মকর্তা আসে না।

কামালপুর গ্রামের আরেক ভুক্তভোগী আব্দুল খালেক বলেন, আগর গছের জন্য যে সময়সীমা দেওয়া হয়েছিল সেটা পার হয়েছে তিন বছর হলো। এখন পর্যন্ত কোনো কিছু দেখতে পারছি না। স্বপ্ন দেখিয়েছিল, আগর বনায়নে ধনী হওয়া যাবে। এখন তো দেখি আগরে ফতুর হয়ে গেছি। এটি এখন অভিশাপের গাছে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া আগরগাছ প্রক্রিয়াকরণের কোনো ব্যবস্থা নেই টাঙ্গাইলে। 

সাঘরদিঘী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. ওয়াজেদ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০০৭-৮ অর্থবছরে আগরগাছের বাগান করা হয়েছিল। বনবিভাগ বলেছিল এগুলো থেকে বহু টাকা আয় হবে। তখন বনবিভাগের সঙ্গে আমাদের দলিলের মাধ্যমে চুক্তিনামা করা হয়েছিল। সেখানে ১০ বছরের মেয়াদ ছিল গাছের। কিন্তু এখন ১২-১৩ বছর পার হচ্ছে কিন্তু গাছের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। প্রথম দিকে বনবিভাগ খোঁজ-খবর নিলেও কয়েক বছর হলো তারা খোঁজ নিচ্ছে না। 

তিনি বলেন, ওই জমিতে অন্যান্য গাছ, বিভিন্ন সবজি বা ফল জাতীয় গাছ লাগালে অনেক লাভবান হতে পারতাম। আগরগাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো কষ বের হতে দেখিনি। এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগও নেয়নি বন কর্তৃপক্ষ।

মধুপুর উপজেলার কুড়াগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল হক বলেন, বনকর্মীদের আশ্বাসে এক যুগ আগে দেড় বিঘায় আগরগাছ লাগিয়েছিলাম। সে গাছ এখন গলার কাটা। সোনার দামে তো দূরের কথা, সস্তা জ্বালানি কাঠ হিসেবেও বিক্রি করা যাচ্ছে না।

টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, মধুপুর ও ঘাটাইল অঞ্চলে সরকারি আগর প্রকল্পের গাছ এখনও পরিপক্ক হয়নি। তাদের আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। এখনও আগর প্রডাশনের অবস্থায় আসেনি। যখন আগর প্রডাকশন হবে তখন তারা বলতে পারবে, তারা লাভবান হয়েছে। আগামী ৫-৬ বছরের আগে গাছ পরিপক্ক হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, আগর গাছগুলো দেখেছি। গাছগুলো এখনও যথেষ্ট চিকন এবং অপরিপক্ক রয়েছে। আরও সময় দিতে হবে। জেলায় প্রসেসিংয়ের ব্যবস্থা করলে সেটা থেকে খুব এটা লাভবান হওয়া যাবে না। এখান থেকে মৌলভীবাজারে পাঠাইতে হবে। 

এসপি