ইতিহাসের বইয়ে মুদ্রিত থাকলেও কোনো স্থাপনা বা ফলকে খোদিত নেই ঐতিহাসিক যশোর রোডের নাম। অ্যালেন গিন্স বার্গের সেই বিখ্যাত কবিতার যশোর রোড বিশ্বখ্যাত হলেও নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে এটি জ্ঞাত নয়। কারণ, যশোর শহর থেকে সুদূর কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত রোডটির ইতিহাস মেলে ধরতে কোনো উদ্যোগ নেই। তাই মহান ’৭১-র স্মৃতিবিজড়িত সড়কটি এখন যশোর-বেনাপোল রোড নামেই পরিচিত। ‘যশোর রোড’ নামটি এখন বিস্মৃতপ্রায়।

অথচ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার খবর বিশ্ববাসীর কাছে পোঁছে গিয়েছিল এই ‘যশোর রোড’র সূত্র ধরে। পাকিস্তানি সেনাদের বর্বর হত্যাযজ্ঞের মুখে প্রাণ বাঁচাতে নিরস্ত্র বাঙালির যশোর রোড দিয়ে ছুটে পালানো দৃশ্যচিত্র বিশ্ববিবেককে নাড়িয়ে দেয়।

অ্যালেন গিন্স বার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটির ছত্রে ছত্রে এই সড়ক ধরে চলা ভারতগামী শরণার্থী বাঙালির অবর্ণনীয় কষ্ট সারা বিশ্বকে কাঁদায়। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন কলকাতা এসেছিলেন মার্কিন এই কবি। যশোর সীমান্ত ও আশপাশের শরণার্থী ক্যাম্প ঘুরে তিনি কবিতাটির এই রসদ জোগাড় করেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে তার বন্ধু বিখ্যাত সংগীতশিল্পী বব ডিলান ও অন্য গায়কদের সহায়তায় শরণার্থীদের জন্য অর্থও সংগ্রহ করেছিলেন।

যশোর জেলার প্রবীণদের মতে, একাত্তরের ভয়াল দিনগুলোয় বাঙালির দুঃখ-দুর্দশার দৃশ্যপট কবিতাটির মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। কবিতার ছত্রে, গানের কলিতে ‘যশোর রোড’ সারা বিশ্বে হয়ে ওঠে পরিচিত। স্থান করে নেয় ঐতিহাসিক মর্যাদা।

সড়কটি ঘুরলে দেখা যায়, সড়কটির যশোর রোড নামকরণের জন্য সরকারি-বেসরকারি কিংবা ব্যক্তিগত কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ অংশের কোথাও এটির নাম যশোর রোড লেখা নেই। সড়কের পাশে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান বা দুই পাশের অগণিত দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁসহ কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডেও যশোর রোড নামটি লেখা নেই।

যশোরের ইতিহাসবিদ ও ঔপন্যাসিক হোসেনউদ্দীন হোসেনের মতে, বাংলাদেশ আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বুক চিরে চলে গেছে এই ঐতিহাসিক সড়ক। যার শুরু বাংলাদেশের যশোর জেলা থেকে, যা বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত বেনাপোল-পেট্রাপোল পেরিয়ে সোজা কলকাতায় গিয়ে মিশেছে। সেই যশোর রোড নিয়ে কত কাহিনি, কত ইতিহাস এখনো ঘুরে বেড়ায় মনে।

স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় এই যশোর রোড হয়ে উঠেছিল এক জীবন্ত ইতিহাস। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক আর্মির বর্বরতা শুরু হলে নিরস্ত্র বাঙালির সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যাওয়ার প্রধান পথ হয়ে ওঠে যশোর রোড। একাত্তরে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষের ভারতে আশ্রয়ে যাওয়ার প্রধান পথ হয়ে ওঠে এই রোড। এই রোডের পাশে কত মুক্তিযোদ্ধা আর শরণার্থী শিবির গড়ে উঠেছিল। এই রোড ঘুরেছেন অনেক নেতা, কবি-সাহিত্যিক।

প্রথমে যশোর থেকে কলকাতায় যাওয়ার বিকল্প মাধ্যম ছিল নৌপথ। তখন যশোরে গড়ে ওঠা উচ্চ ও মধ্যম শ্রেণির প্রায় সবাই ছিলেন হিন্দু। সেই সময় এই পথ ধরে বহু হিন্দু নারী গঙ্গাস্নানের জন্য নদীপথে কলকাতা যেতেন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, যশোর শহরের বকচরের জমিদার ছিলেন কালী প্রসাদ পোদ্দার। কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে তার ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। নৌকার মাঝিদের অসহযোগিতার কারণে একবার জমিদারের মা যশোদা গঙ্গাস্নানে যেতে না পারায় নিজেকে অপমানিত বোধ করে ঘরের দরজা বন্ধ করে অনশনে বসেন। গঙ্গাস্নানের জন্য যশোর থেকে চাকদা পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করে দিলেই তিনি অনশন প্রত্যাহার করবেন। পুত্র কালী প্রসাদ মায়ের দাবি মেনে রাস্তা নির্মাণ করেন। সেই থেকে এই রাস্তাকে কালী বাবুর সড়ক বলেও অভিহিত করা হয়।

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সড়কটি আবারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বৃষ্টি আর কাদাপানি উপেক্ষা করে ভয়াল দিনগুলোয় লাখ লাখ মানুষ ঘর ছেড়েছিল এই পথ ধরে, অজানার উদ্দেশে। পেছনে মৃত্যু, সম্মুখে অনিশ্চয়তা নিয়ে মানুষ পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমিয়েছিল। এদিকে যশোর থেকে নদীয়ার গঙ্গাঘাট পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার সড়কের ১৬৮ বছর আগে রোপিত প্রবীণ গাছগুলো আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কালী পোদ্দারের সেই যশোর রোড আজ নেই, বাংলাদেশ অংশে যা আছে, তা যশোর-বেনাপোল সড়ক। কালীগঞ্জ হয়ে বেনাপোল পর্যন্ত এই রাস্তার দুধারে শত শত সাইনবোর্ডে আজ শোভা পাচ্ছে ‘বেনাপোল রোড’। কিন্তু বেনাপোল সীমান্ত পেরোলেই ভারতের পেট্রাপোল থেকে শুরু করে কলকাতার গঙ্গা তীরের কালীঘাট মন্দির পর্যন্ত রাস্তাটি আজও ‘যশোর রোড’ নামে ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে আছে।

ঝিকরগাছার স্থানীয় সাংবাদিক এম আর মাসুদ বলেন, সড়কটির ইতিহাস সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সরকারের কাছে আহ্বান জানাই, ইতিহাসসমৃদ্ধ সড়কটির নামকরণ ‘যশোর রোড’ এবং প্রবেশদ্বারে কোনো ফলক নির্মাণ করা হোক।

ঝিকরগাছা মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন বলেন, যশোর রোড যশোরবাসীর জন্য বিরাট এক ইতিহাসের সাক্ষী। সড়কটি বহন করছে মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যও। কালের সাক্ষী ও স্মৃতি রক্ষার্থে সড়কটি ও এর পাশে থাকা বিশাল আকৃতি রেইনট্রি (বৃষ্টি শিরীষ) গাছগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা দরকার।

মুক্তিযুদ্ধকালীন বৃহত্তর যশোরের মুজিব বাহিনীর উপপ্রধান অ্যাডভোকেট রবিউল আলমের ভাষ্য, ২৫ মার্চের পর থেকে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি আর্মিরা যশোর শহরে অবস্থান নিতে থাকে। এরপর থেকে শুরু হয় তাদের হত্যাযজ্ঞ। রাস্তার ধারের পথচারী ও ঘুমন্ত সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করা শুরু হয়। উত্তাল সেই দিনগুলোয় যশোর রোড দিয়ে মানুষ ভারত ছুটতে থাকে। অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্য দিয়ে তারা এই পথ দিয়ে ভারত গমন করে।

তিনি বলেন, খুলনার ডাক বাংলো রোড থেকে নওয়াপাড়া কয়লা ঘাট পর্যন্ত সড়কটিকে ‘যশোর রোড’ বলে ডাকে খুলনার মানুষ। অথচ যশোরেই এই নাম ব্যবহার করা হচ্ছে না। আইন করে এই রোডের নাম ‘যশোর রোড’ ব্যবহার করার নিয়ম জারি করতে হবে। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের এই স্মারক সড়কটি সম্পর্কে ভব্যিষৎ প্রজন্ম জানতে পারে।

যশোরের ইতিহাস গবেষক ও সাংবাদিক সাজেদ রহমান বলেন, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু মার্কিন কবি ও সাংবাদিক অ্যালেন গিন্সবার্গ ভারতের শরণার্থী শিবিরে বাঙালিদের দুর্বিষহ জীবনকে প্রত্যক্ষ করেন। লাখো দুর্দশাপীড়িত মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে প্রতিবাদী কবিতা লিখেছিলেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামে। মুক্তিযুদ্ধে যশোর রোড ঐতিহাসিক হলেও এর স্মৃতি রক্ষার্থে এখানে তেমন কোনো কিছুই করা হয়নি। বিষয়টি দুঃখজনক। আমরা মনে করি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য এ ব্যাপারে সরকারকে এগিয়ে আসা উচিত।

জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যশোর রোডের নাম জড়িত রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীরা এই যশোর রোড দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আবার এই সড়ক দিয়ে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ ভারতে শরণার্থী হয়ে ছুটতে থাকে। শরণার্থীদের নিয়ে মার্কিন কবি সড়কটি নিয়ে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামে একটি কবিতাও লিখেছিলেন, যেটি সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।

তিনি বলেন, ‘যশোর রোড’ নামকরণে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে আমি মনে করি। আগামী জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় বিষয়টি উস্থাপন করা হবে। ঐতিহাসিক বিবেচনায় এই রোডের প্রবেশদ্বারে একটি গেট নির্মাণ বা ফলক নির্মাণের জন্য যশোরের সব সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথা বলব।

এনএ