বেহাল অবস্থায় শুভপুর ব্রিজ 

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বুকে ধারণ করে সাক্ষী হয়ে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে ফেনীর ছাগলনাইয়ার শুভপুর ব্রিজ। শুভপুর-মিরসরাই উপজেলার করেরহাটের মাঝামাঝি ফেনী নদীর ওপর অবস্থিত এ ব্রিজ। ৬৮ বছরের পুরোনো ব্রিজটি এখন ধ্বংসের পথে।

দুর্ঘটনা এড়াতে ব্রিজটির ওপর ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে সড়ক বিভাগ। ব্রিজের ওপর খুঁটি গেঁথে রাখায় বাস, পণ্যবাহী ট্রাক অতিক্রম করতে পারছে না। ভাঙন ও ফাঁটলের কারণে নাজুক অবস্থার মধ্যে ব্রিজটি এখন মরণফাঁদ। স্থায়ীভাবে মেরামত না হওয়ায় দিন দিন ঝুঁকিতে পড়ছেন ব্যবহারকারীরা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৫২ সালে স্থাপিত হওয়া ১২শ ফুট দীর্ঘ ব্রিজটি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গোলার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ঢালাইয়ের কার্পেটিংয়ের রড নিচের দিকে ধসে যাওয়া ও কাঠামো দুর্বল হয়ে যাওয়ায় যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। ব্রিজের পাশে অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের কারণে ব্রিজের নিচে পিলারের পাশের মাটি সরে যাচ্ছে। পিলারগুলো নড়বড়ে হয়ে গেছে। যে কোনো সময় ব্রিজ ধসে পরতে পারে।

১৯৫২ সালের দিকে ইস্পাত দিয়ে ১২৯ মিটার দৈর্ঘ্য ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়। পরে নদীর প্রশস্থতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৬৮ সালে ব্রিজটিতে ২৪৯ মিটার সম্প্রসারণ করা হয়। এতে করে ব্রিজের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৩৭৪ মিটার। এটি ছিল দক্ষিণাঞ্চলের মহাসড়কে তৎকালীন দীর্ঘতম সেতু।

বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান, চট্টগ্রাম তথা মীরসরাইয়ের প্রবেশদ্বারে অবস্থিত এ ব্রিজের দখল নিয়েই ১৯৭১ সালে দফায় দফায় পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। পাকিস্তানি বাহিনী যাতে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এ ব্রিজ অতিক্রম করে চট্টগ্রাম প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য মুক্তিযোদ্ধারা যেমন ব্রিজটি ধ্বংসের চেষ্টা চালায় তেমনি ব্রিজটি রক্ষা ও দখলে রাখার জন্যও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল হানাদার বাহিনী।

ভাঙনের কারণে ব্রিজটি এখন মরণফাঁদ

বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন জানান, শুভপুর ব্রিজের যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ বলে স্বীকৃত। কারণ চট্টগ্রামের যত মুক্তিযোদ্ধা ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং আশ্রয় নেন তারা এ শুভপুর ব্রিজ অতিক্রম করে গিয়েছিলেন। ব্রিজের ১০ নম্বর পিলারে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিলে এ অংশ হানাদারমুক্ত। 

তিনি আরও বলেন, ১৯৮০’র দশকে সরকারি অর্থায়নে শুভপুর ব্রিজের যুদ্ধ নিয়ে ‘কলমি লতা’ নামে একটি ছায়াছবিও নির্মিত হয়েছিল। এছাড়া ১৯৯৬ সালে বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উদ্যোগেও অংশগ্রহণে শুভপুর ব্রিজ নিয়ে যুদ্ধভিত্তিক একটি প্রামাণ্য চিত্র বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছিল। ব্রিজের খুব কাছাকাছি গেলে এখনও দেখা যায় অসংখ্য বুলেট ও কামানের আঘাতের চিহ্ন। যা স্মরণ করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের কথা।

ফেনী সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, নদীর গতিবিধি নির্ণয়ের জন্য হাইড্রোলজিক্যাল ও মরফোলজিক্যাল স্টাডি শেষ হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে এই প্রতিবেদন পেশ করা হবে। এই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ব্রিজের ডিজাইন করা হবে। এরপর সেতুর জন্য বরাদ্দ দেওয়া হলে ২০২১ সালের শেষ নাগাদ কাজ শুরু হবে।

ছাগলনাইয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মেজবাউল হায়দার চৌধুরী সোহেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই ব্রিজটি কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়; এটি আমাদের ইতিহাসের অংশ। এই জায়গায় নতুন ব্রিজ তৈরির প্রক্রিয়া চলমান। নতুন ব্রিজ হলেও পুরোনো এই ব্রিজটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্বরূপ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হবে। 

এসপি