গোপিনাথ সাহা

গোপিনাথ সাহার বয়স ৮৫ বছর। ফরিদপুর সদরের মাচ্চর ইউনিয়নের বাকচর গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসরদের হাতে শহীদ হন বাবা উপেন্দ্র্র নারায়ণ সাহা, চাচা কুমার সাহাসহ ১৭ জন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে সল্টলেক, রানাঘাট, কৃষ্ণনগর, মধ্যমগ্রামসহ বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে হাইকমিশনারের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন।

সেই গোপিনাথ সাহা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখনো স্বীকৃতি পাননি। স্বীকৃতির জন্য বারবার জেলা প্রশাসক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেও কোনো কাজ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্মৃতি তিনি রোমন্থন করেন ঢাকা পোস্টের কাছে। আক্ষেপও করেন তার বীর মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি না পাওয়ায়।

ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট মহল্লার মদনগোপাল আঙিনার পাশে ভাড়াবাড়িতে এক ছেলেকে নিয়ে বসবাস করছেন তিনি। স্ত্রী শান্তি রানী সাহা ৩ বছর আগে মারা গেছেন। এক মেয়ে শিবানী সাহাকে বিয়ে দিয়েছেন মাদারীপুরের শিবচরে।

গোপিনাথ সাহা জানান, মুক্তিযুদ্ধের আগে কার্য সহকারী হিসেবে ১৯৬৬ সালে ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডে কর্মজীবন শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল ফরিদপুরের পরাজয় হলে তিনি কর্মস্থল ত্যাগ করে চলে যান ভারতে। ভারতে গিয়ে কলকাতার হাইকমিশনে গিয়ে করণিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে হাইকমিশনারের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৯ বৈশাখ দিনটি তার জন্য এক বেদনাদায়ক দিন ছিল। সেদিন তিনি ভারতে থাকলেও দেশে এসে জানতে পারেন তাদের ফরিদপুর সদরের মাচ্চর ইউনিয়নের বাকচর গ্রামের বাড়িতে অবস্থানরত বাবা উপেন্দ্র নারায়ণ সাহা, চাচা কুমার সাহাসহ গ্রামের ১৭ জন শহীদ হয়েছেন পাকিস্তানি দোসরদের হাতে।

শহীদ পরিবারের সন্তান গোপিনাথ সাহা মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে পুনরায় যোগ দেন ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডে। তাকে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নয় মাসের বেতন প্রদান করা হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দুই বছরের সিনিয়রিটি ও দুটি ইনক্রিমেন্টও দেওয়া হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৯৩ সালে স্টোরকিপার হিসেবে তিনি অবসরে যান। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও তিনি পাননি তার স্বীকৃতি।

সবশেষ ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর কাছে ‘মুজিবনগর কর্মচারী হিসাবে তালিকাভুক্তি ও গেজেট আকারে নাম প্রকাশের আবেদন’ করেন। পরে মন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আবেদনপত্রের অনুলিপি তিনি জামুকায় জমা দেন।

তিনি বলেন, জামুকায় অনুলিপি জমা দেওয়ার পর বহুদিন চলে গেছে, জামুকা থেকে কোনো চিঠি দিয়ে আমাকে কিছু জানায়নি। আমি জানি না, কবে এ স্বীকৃতি পাওয়া যাবে। যে দেশের জন্য এত করেছি সে দেশে মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি নিয়ে শেষশয্যায় যেতে পারব কি না জানি না।

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, যে দেশের মুক্তির জন্য এত কিছু করলাম সেই দেশ কী আমাকে স্বীকৃতি না দিয়েই আমাকে অন্তিমশয্যায় পাঠাবে? জানা যায়, বর্তমানে তিনি মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। অর্থাভাবে দিন কাটছে তার। বাবার মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতির জন্য অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছেন ছেলে শঙ্কর সাহা। তিনিও এখন ক্লান্ত।

ছেলে শঙ্কর সাহা বলেন, জামুকায় বাবার স্বীকৃতির ব্যাপারে বারবার যোগাযোগ করেছি। সেখান থেকে আমাকে বলা হয়, এগুলো হয়ে গেছে, এখন এসব নিয়ে যোগাযোগ করে লাভ নেই। এরপরও ছেলে শঙ্কর হাল ছাড়েননি। গিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক
মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের কাছে। মন্ত্রী আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, পরবর্তীতে তার বাবার বিষয়টি তিনি দেখবেন।

এরপর তিনি চলতি বছরের ১১ আগস্ট ফরিদপুর জেলা প্রশাসকের কাছে একই আবেদন (যেটি জামুকায় জমা দিয়েছেন) সম্বলিত একটি চিঠি জমা দিয়েছেন। ওই দিনই (১১ আগস্ট) ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে আবেদনপত্রটি পাঠিয়ে দেন।

এ ব্যাপারে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বলেন, গোপিনাথ সাহার আবেদন পাওয়ার পর সেদিনই সেটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এমএসআর