পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের সাবেক ছাত্রনেতা (জিএস) বীর মুক্তিযোদ্ধা ইশারত আলী জিন্নাহ অর্থের অভাবে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা হচ্ছে না। এখন শয্যাশায়ী অবস্থায় বাড়িতে অবস্থান করছেন। ছয় বছর হলো দৃষ্টিশক্তি হারালেও তিন বছর ধরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নিজ বাড়িতে এখন শয্যাশায়ী।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, প্রায় চার লাখ টাকার প্রয়োজন হবে তার চিকিৎসা করাতে। কিন্তু এত টাকা জোগাড় করতে না পেরে বাড়িতে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তিনি। একটি জীর্ণশীর্ণ ঘরে পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন।

ইশারাত আলী সদর উপজেলার দোগাছি ইউনিয়নের বোবড়াখালি গ্রামের মৃত আছালত প্রামাণিকের ছেলে। তিনি সর্বপ্রথম (১৯৭২-৭৩) সালে পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র সংসদের জাসদ ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে নির্বাচিত জিএস ছিলেন। পাবনার চাটমোহর ও আটঘরিয়া এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ করে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফেরেন। মুক্তিযুদ্ধের ‘লাল মুক্তিবার্তা’ নং-০৩১১০১২৪৫। সনদ নং- ২৯২। সাংসারিক জীবনে তিনি ২ মেয়ে ১ ছেলের জনক।

পরিবার জানায়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চিকিৎসা ভাতা বরাদ্দ প্রদান করা হলেও তিনি এখন পর্যন্ত কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিন বছর ধরে বিছানায় মানবেতর জীবনযাপন করলেও কেউ খোঁজ রাখে না। তাকে দেখতে পর্যন্ত আসে না কেউ। সন্তানদের পড়ালেখা করানো ও সংসার পরিচালনা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তারপরও প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার ওষুধ খেতে হয়। পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছেন। নিজে একা একা চলতে-ফিরতে পারেন না। সব কাজ অন্যের সাহায্যে করতে হয়। বর্তমানে লাঠিভর দিয়েও চলাচল করতে পারেন না।

দুঃখভরা কণ্ঠে ইশারত আলী জিন্নাহ বলেন, দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছি। ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হয়ে ক্যাস্পাস কাঁপিয়েছিলাম। মিছিল-মিটিংয়ে পুরো ক্যাম্পাস মুখর রেখেছি। আমার কথামতো হাজার হাজার ছাত্র-জনতা রাজপথে আন্দোলন করত। জ্বালাময়ী বক্তব্য শুরু করলে হাজার হাজার লোক বক্তব্য শোনার জন্য জমায়েত হতো। তিন বছর ধরে কঠিন সময় পার করছি। আজ কেউ খোঁজ নেয় না। অনেক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ফোন রিসিভ করে না। আমি এখন বড় অসহায়।

তার স্ত্রী রাজেদা আক্তার বলেন, ধীরে ধীরে আমার স্বামী মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। সরকার থেকে মাসিক যে অনুদান (ভাতা) পান, সেটা দিয়ে সংসার খরচই চলে না। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে দিয়ে ঠিকমতো প্রাইভেট পড়াতে পারি না। প্রতি মাসে চিকিৎসাবাবদ ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা লাগে। চিকিৎসকরা বলেছেন আমার স্বামীর চিকিৎসার জন্য প্রায় চার লাখ টাকা প্রয়োজন। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না। আমরা পরিবারসহ মানবেতর জীবন যাপন করছি। আমাদের দেখার কেউ নেই।

সুজানগর পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমান সরকার অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা দিলেও একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তিন বছর ধরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী, কিন্তু এখনো চিকিৎসা খরচ না পাওয়া খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। অথচ এই মুক্তিযোদ্ধাই একসময় পুরো জেলাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। পরিবার-পরিজনের কথা চিন্তা না করে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

বাংলাদেশ জাসদের পাবনা জেলা শাখার সভাপতি বিশিষ্ট কলামিস্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিরুল ইসলাম রাঙা ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিনি একজন প্রখ্যাত ছাত্রনেতা ছিলেন। এডওয়ার্ড কলেজের সর্বপ্রথম জিএস ছিলেন ও বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ও প্রভাবশালী ছাত্রনেতা ছিলেন। তিনি সুঠাম দেহের ব্যক্তি ছিলেন। অথচ সেই মানুষটির অসহায়ত্বের কথা শুনে আজ খুবই খারাপ লাগে। বর্তমানে দেশে অনেক বিত্তশালী-হৃদয়বান মানুষ আছেন তারা যদি বীর মুক্তিযোদ্ধা ইশারতের জন্য আর্থিক সহযোগিতা করেন, তার জন্য ভালোই হয়।

পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ’৭১ পাবনা শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম পাকন ঢাকা পোস্টকে জানান, মুক্তিযোদ্ধা ইশারত বিশিষ্ট ছাত্রনেতা ছিলেন। সেই সময় পুরো ক্যাম্পাস কাঁপিয়ে তুলতেন। আজ সেই ছাত্রনেতা অসহায় অবস্থায় শয্যাশায়ী হয়ে আছেন। আমরা নিয়মিত তার খোঁজখবর নিচ্ছি। থাকার জন্য একটি ঘর বরাদ্দের জন্য সুপারিশ করা হবে। সাবির্কভাবে আর্থিক সহায়তা করার চেষ্টা করা হবে। দেশের বিত্তশালীদের প্রতিও আহ্বানও জানান তিনি।

পাবনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার রেইনা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইশারতকে এর আগে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা হয়েছিল। সেটা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তবে তার দীর্ঘমেয়াদি রোগ রয়েছে, সে বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বার্ষিক অনুদানের বরাদ্দ এলে তার জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।

রাকিব হাসনাত/এনএ