শিল্প-সাহিত্য হলো মনের খোরাক। আর সেই খোরাকই যখন মানুষের জীবনে শেষ অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়, তখন উপমা দেওয়ার মতো আর কিছুই বাকি থাকে না। সংসারের হাল ধরতে শেষ বয়সে বেছে নেওয়া কবিগান, কবিতা পাঠ করে দুঃখ-কষ্টকে সঙ্গী করে পথচলার এক বৃদ্ধার নাম রাধাপদ সরকার (৮০)।

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের গোদ্ধারের পাড় গ্রামের বাসিন্দা রাধাপদ বেশিদূর পড়ালেখা করতে পারেননি। পড়েছেন মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু তার রয়েছে যেকোনো বিষয়ে ওপর গান, কবিতা লেখার প্রতিভা। আর তা মানুষকে শুনিয়ে সামান্য উপার্জনে চলে তার ছয় সদস্যের সংসার।

আঞ্চলিক ভাষায় তার গান ও কবিতাগুলো গ্রামে গ্রামে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ইতিমধ্যে তার লেখা কবিতা ‘কেয়ামতের আলামত জানি কিন্তু মানি না’। শিরোনামে কবিতাটি এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও ভাইরাল হয়েছে। এখন পর্যন্ত রাধাপদ সরকারের নিজের লেখা আঞ্চলিক ভাষায় শতাধিক গান ও কবিতা রয়েছে।

রাধাপদ সরকারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭৪ সালে জীবন জীবিকা নির্বাহের তাগিদে রাধাপদ চলে যান রাজধানী ঢাকায়। সেখানেই পেশা হিসেবে নেন রাজমিস্ত্রির কাজ। ওই তৎকালীন ঢাকায় এক বৃদ্ধার মাথার পাকা চুল কালো করা দেখেই নাকি জীবনের প্রথম একটি কবিতা লিখেছেন। তিনি সে সময় জানতেন না যে পাকা চুল কালো করা যায়। মূলত সেই চিন্তা থেকেই তখন কবিতা ও গান লেখেন তিনি। পরবর্তী সময়ে সেই মিস্ত্রির কাজ বাধ দিয়ে চলে আসেন নিজ এলাকায়, হয়ে পড়েন বেকার। নিজের লেখা কবিতা ও গানে মনোযোগ দিলে বন্ধ হয় তার উপার্জনের রাস্তা।

কিছুদিন পর এলাকাবাসীর আয়োজনে গান ও কবিতার আসর করেন তিনি। তখন থেকে গান ও কবিতা পরিবেশ করে যে সামান্য অর্থ পেতেন, তা দিয়ে কোনো রকমে চলে তার সংসার। তবে রাধাপদ সরকার এই বৃদ্ধ বয়সেও এসেও তার নিজের লেখা গান ও কবিতা পরিবেশন করছেন। তাতে যে সামান্য কিছু টাকা পান, তা দিয়েই চলছে ৬ সদস্যের অভাব-অনটনের সংসার।

রাধাপদ সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ১৯৭১ সালের পর জমিজমা বিক্রি করে ভারতে চলে যাই। ওখানে ভালো না লাগায় আবার চলে আসি দেশে। রডমিস্ত্রির কাজে ঢাকা যাই। সেখানে কাজ করে কোনো রকমভাবে ছেলে-মেয়েদের বড় করার পড় তাদের বিয়ে দিই। এর মাঝে চলত গান-কবিতা লেখা। পরে রডমিস্ত্রির কাজ ছেড়ে পেশা হিসেবে নিই গান-কবিতা লেখাকে। সেই গান ও কবিতা গ্রামে গ্রামে মানুষকে শুনিয়ে সামান্য কিছু টাকা পাই। তা দিয়েই কোনো রকম সংসারটা চালাচ্ছি। বয়স বেশি হয়ে গেছে। তাই এখন অন্য কোনো কাজ করতে পারি না।

ওই গ্রামের পরিমল নামের একজন বলেন, রাধাপদ আমার সম্পর্কে চাচা হন। তার ছেলেরা ঠিকমতো তার ভরণপোষণ দেন না। তিনি অন্য কাম-কাজও করতে পারেন না। তার নিজের লেখা গান-কবিতা মানুষকে শুনিয়ে কিছু অর্থ পান, তা দিয়েই চলছে তার সংসার।

স্থানীয় দুর্গা রানী বলেন, তিনি বিভিন্ন এলাকায় গানবাজনা করেন। মানুষ গান শুনে কিছু টাকাপয়সা দেয়। সেই টাকা দিয়েই এই বয়সে সংসার চালাচ্ছেন।

নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, রাধাপদ সরকারের অনেক বয়স হয়ে গেছে। কাজ-কর্ম করতে পারেন না। এই বয়সে তার লেখা গান-কবিতা বিভিন্ন স্থানে পরিবেশ করে যে অর্থ পান, তা দিয়েই কোনোরকমভাবে সংসারে ব্যয় বহন করে আসছেন।

তিনি আরও জানান, বাড়ি-ভিটা ছাড়া তার জায়গা-জমি বলতে কিছুই নাই। আঞ্চলিক ভাষায় গান-কবিতায় রয়েছে তার দারুণ প্রতিভা। যেকোনো বিষয়ের ওপর গান ও কবিতা তৈরি করার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে তার। ধর্মীয় ও সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে সব সময় দেখা যায়। যদি সরকারিভাবে কোনো সুযোগ-সুবিধা পেতেন, তাহলে আরও ভালো কিছু করতেন এবং এই বয়সে একটু ভালো থাকতেন।

এনএ