আশ্রয়ণ প্রকল্পে মাথা গোঁজার স্থায়ী ঠিকানা পাওয়া ছাদেকা বেগম

মঙ্গাপীড়িত ‘বাহের দেশ’ হিসেবে পরিচিত রংপুর। এক সময়ের উন্নয়নবঞ্চিত এই জেলা এখন বদলে গেছে। গ্রামের রাস্তাগুলোও এখন পিচঢালা। রাস্তার দু’পাশে বনায়ন। হাট-বাজারের পাশাপাশি গ্রামেও গড়ে উঠেছে পাকা বাড়ি। 

তবে বেশির ভাগ বাড়ি টিনের তৈরি ও আধা পাকা। মাঝেমধ্যে চোখে পড়বে কাঁচা বাড়িও। মেঠোপথ ধরে চলতে একটু পর পর বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ আর সবুজের হাতছানি। এমনি এক গ্রাম পালিচড়ার বালুয়াপাড়া। রংপুর সদর উপজেলার সদ্যপুষ্কুরণী ইউনিয়নের পালিচড়া বাজার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার এগোলে বালুয়াপাড়া। এই গ্রামে ঢুকতে নজর কাড়বে লাল-সবুজ আর স্কাইব্লু রঙের পাকা ঘর। পাশেই আরও ঘর তৈরির কাজ চলছে। সব মিলিয়ে ২৫ পরিবারের জন্য তৈরি হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের এসব উপহার।

নতুন ঘরের চাবি হাতে পেয়ে আনন্দে আপ্লুত তারা

শনিবার (২৩ জানুয়ারি) দুপুরে রংপুর সদর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে পালিচড়ার বালুয়াপাড়া গ্রামের ছাদেকা বেগমের হাতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের জমির দলিলসহ প্রয়োজনীয় কাজগপত্র তুলে দেওয়া হয়।

এ সময় রংপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শুকরিয়া পারভীন, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইসরাত সাদিয়া সুমি, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নাছিমা জামান ববিসহ জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

নতুন ঘরের চাবি। কাঁচা-পাকা বাড়ি। সঙ্গে জমির দলিল হাতে পেয়ে ছাদেকা বেগমের দু’চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে। আনন্দে আপ্লুত হন তিনি। ছাদেকার মতো ভূমিহীন আবুল খায়ের, হালিম, জুলেখার স্থায়ী ঠিকানা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে।

মাথা গোঁজার স্থায়ী ঠিকানা হওয়ায় ছাদেকা বেগম (৬৫) ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘স্বামী নাই। মেলাদিন আগোত মরি গেইছে। এতদিন বেটির বাড়িত ছিনো। মাইনসের বাড়িত কাম কাজ করি, আইত হইলে বেটির বাড়িত য্যায়া থাকছি। এ্যালা তো সরকার থাকি ঘর পাইনো। খুব ভালো নাগোচে। খালি ভুই কওলা আর রেজিস্ট্রি করতে সোগ মিলি ১৭শ টাকা নাগছে। এই টাকাতে প্রধানমন্ত্রী হামাক লাখ লাখ টাকার জমিসহ পাকা ঘর করি দিলে। এই জনতে প্রধানমন্ত্রীক হামার ধন্যবাদ। আল্লাহ তাক যুগ যুগ বাঁচি থুক।’

বালুয়াপাড়াতে যারা ঘর পেয়েছেন, তাদের এতদিন তাদের পরিচয় ছিল ভূমিহীন ও গৃহহীন। এই নামেই সবাই তাদের চিনতেন ও জানতেন। মানুষের কাছে তারা ছিলেন যাযাবর। কিন্তু এবার একসঙ্গে তাদের সেই নাম পরিচয় মুছে গেল। ভূমিহীন-গৃহহীন থেকে তারা এখন সবাই লাখপতি। 

মানুষের কাছে তাদের পরিচয় ছিল যাযাবর, সেই গ্লানি মুছে গেল তাদের

তাদের জন্য সরকারের উপহার প্রায় পৌনে দুই লাখ টাকার আধা পাকা ঘর আর কয়েক লাখ টাকার ভিটেমাটি। প্রতিটি পরিবারের নামে দুই শতাংশ খাস জমি বন্দোবস্ত দিয়ে ঘরগুলো বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে এমন উপহার পেয়ে আবেগাপ্লুত ও উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছেন এসব পরিবারের সদস্যরা।

এদিকে, নতুন ঘর আর স্থায়ী ঠিকানা পেয়ে উদ্বেলিত বালুয়াপাড়ার জুলেখা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এই বৃদ্ধা বলেন, ‌‘মুই কোনোদিন ভাবো নাই পাকা ঘরোত থাকিম। গরিব মানুষ, নিজের থাকার জাগা নাই। পাকা ঘর করিম ক্যামন করি। সেই মুই মানুষট্যা এ্যালা পাকা ঘরোত থাকিম। আল্লাহ মোর পাকে দেখছে। এই প্রধানমন্ত্রী দেশের ভার নেবার পর থাকি হামার মতো গরিব মাইনসের উপকার হওছে। এই ঋণ তো শোধ হবার মতো না। আল্লাহ তাক যুগ যুগ বাঁচি থুক।’

তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের ফরিদাবাদ গ্রামের নবনির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঠাঁই পাওয়া মোবারক হোসেন বলেন, সরকারের এই উদ্যোগ খুব ভালো। কোনো টাকা পাইসা নাগিল না। সরকার হামাক লাখ লাখ টাকার জমিজমা, ঘর দিলে। এটাতো ইয়ার আগোত কায়ো করে নাই। প্রধানমন্ত্রীক ধন্যবাদ দেই। দোয়া করি, তায় যেন সুস্থ থাকে। মেলাদিন বাঁচি থাকে।’

রংপুর জেলায় জমিসহ সুবিধাভোগীদের মধ্যে কাউনিয়া উপজেলায় ১২০ পরিবার, রংপুর সদরের ৫০ পরিবার, গঙ্গাচড়ায় ১০০, তারাগঞ্জে ২০০, পীরগাছায় ২২০, মিঠাপুকুরে ১৯৭, বদরগঞ্জে ২৮৬ ও পীরগঞ্জে ১০০ পরিবারের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ঘর দেওয়া হয়েছে। এ বছরের মার্চের মধ্যে বাকি ঘরগুলো সুবিধাভোগীদের দেওয়া হবে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে শনিবার দেশের ৪৯২ উপজেলার প্রায় ৭০ হাজার পরিবারকে পাকা ঘরসহ বাড়ি ও জমি হস্তান্তর করা হয়। শনিবার সকালে গণভবন থেকে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশব্যাপী বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় নির্মিত এসব ঘর হস্তান্তর কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এরপরই সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা কর্মকর্তারা সুবিধাভোগীদের হাতে ঘরের চাবি ও জমির দলিল তুলে দেন।

তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের ফরিদাবাদ গ্রামের নবনির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঠাঁই পেয়েছেন মোবারক হোসেন

রংপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) আসিব আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিটি ঘর নির্মাণে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। এই টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দুটি করে বেড রুম, একটি টয়লেট, একটি স্টোর রুম কাম রান্না ঘর। চারদিকে ইটের দেয়াল এবং ওপরে লাল-সবুজ রঙের টিনের ছাদ রয়েছে। দুই শতাংশ খাস জমির ওপর এসব বাড়ি নির্মাণ করা হয়। ভূমিহীনদের দুই শতক জমির দলিল, নামজারি, জমির মালিকানা কবুলিয়তনামা এবং ঘরের চাবি দেওয়া হয়।

রংপুর বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) আবু তাহের মো. মাসুদ রানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মুজিববর্ষে রংপুর বিভাগে শুধু ‘ক’ শ্রেণির ১৩ হাজার ১১০টি ভূমিহীন এবং গৃহহীন পরিবারকে ঘর দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৪২০টি এবং বিলুপ্ত ছিটমহলে বসবাসকারী পরিবার আছে ৮৭টি। প্রথম পর্যায়ে শনিবার নয় হাজার ১৯৫ পরিবারকে ঘর দেওয়া হয়েছে। এসব ঘর নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ২২৪ কোটি ১৮ লাখ ১০ হাজার টাকা। খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাকি ঘরগুলো দেওয়া হবে।

এএম