মুন্সিগঞ্জ তথা বিক্রমপুরের ঐতিহ্য কাঠের নান্দনিক কারুকার্যখচিত ঘর। এখন লাল, সবুজ ও হলুদ রঙের টিন ব্যবহার করায় একদিকে কাঠের কারুকার্য, অন্যদিকে বাহারি টিনের সৌন্দর্যে মানুষ এ ঘরের প্রতি দিন দিন ঝুঁকে পড়ছে। স্থানীয়দের কাছে এসব ঘরের চাহিদা বেড়েছে।

অন্যদিকে জেলার বাইরের মানুষের কাছে এসব ঘরের চাহিদা বাড়ায় জেলার ছয় উপজেলাতেই এখন বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন একতলা, দোতলা, চৌচালা, সাতচালা, টপ-বারান্দার টিন-কাঠের ঘর।

ছয়টি উপজেলার ঘর ব্যবসায়ীরা স্থানীয় হাটবাজারের পাশে পরিত্যক্ত ভিটায় এসব ঘর বানিয়ে রাখেন। দূরদূরান্ত থেকে ক্রেতারা এসব হাটে এসে পছন্দসই ঘর নিয়ে যান। আবার অনেক ক্রেতা আগে থেকেই অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নেন এসব দৃষ্টিনন্দন ঘর। স্থানীয়দের ভাষায় এসব ঘরের নাম ‘রেডিমেড ঘর’। ঘর তৈরিতে সময় ও ব্যয় কম লাগায় দিন দিন বেড়েই চলছে এসব তৈরি ঘরের চাহিদা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এসব ঘর তৈরির কাজে স্থানীয় মিস্ত্রিসহ (কারিগর) দেশের বিভিন্ন জেলার মিস্ত্রিরা কাজ করে থাকেন। তবে গোপালগঞ্জ জেলার মিস্ত্রিরা এসব ঘর তৈরিতে খুবই পারদর্শী হওয়ায় শুধু গোপালগঞ্জ জেলার ১ হাজারের বেশি মিস্ত্রি এ জেলায় ঘর তৈরির কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। জেলার বাইরের ক্রেতারা ঘর কেনার পর ওই ঘরগুলো ক্রেতাদের বাড়িতে গিয়ে তুলে (ফিটিং) করে দিয়ে আসেন ঘর তৈরি কাজে নিয়োজিত মিস্ত্রিরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, মুন্সিগঞ্জ সদর, টঙ্গিবাড়ী, লৌহজং ও সিরাজদিখান উপজেলায় এসব ঘর নির্মাণে ব্যস্ততা চলছে। লাল, সবুজ ও হলুদ টিন ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন এসব ঘর। আগে শুধু সাদা টিন ব্যবহার করে ঘর তৈরি করা হতো। ক্রেতাদের চাহিদা ও আকর্ষণীয় করার জন্যই ঘর তৈরিতে এসেছে পরিবর্তন।

ঘর বিক্রির প্রতিষ্ঠানগুলোয় রাখা হয়েছে সারি সারি কারুকার্যময় টিন-কাঠ দিয়ে তৈরি ঘর, যা দেখলেই যে কারোরই চোখ জুড়াবে। ব্যবসায়ীরা জানান, এসব হাটে দোতলা ঘর একটি ১৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এদিকে চারদিকে নদীবেষ্টিত মুন্সিগঞ্জ জেলা, নদীভাঙনকবলিত অঞ্চল হওয়ায় এখানে টিন-কাঠের ঘরের কদর বেশি। ঘরগুলো স্থানান্তরযোগ্য হিসেবে তৈরি করায় ভাঙন দেখা দিলে সহজেই সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়। এ ছাড়া প্রয়োজনে নগদ টাকায় বিক্রি করারও সুযোগ রয়েছে। তাই স্থানীয়দের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ বিল্ডিং না করে টিনের ঘর করেন।

ঘর তৈরির কারিগররা জানান, আকৃতিভেদে বিভিন্ন কাঠ দিয়ে একেকটি ঘর তৈরিতে সময় লাগে ৭ থেকে ১ মাস সময় পর্যন্ত। তবে নান্দনিক দোতলা ও তিন তলা ঘর তুলতে কয়েক মাস লেগে যায়। দোতলা ও তিন তলা ঘরে নকশা ও কারুকাজ বেশি হওয়ায় সময়ও অনেক বেশি লেগে যায়। কাঠের নান্দনিক নকশার কারণে এ অঞ্চলে তৈরি ঘরগুলো অনেক বেশি কাঠের প্রয়োজন হয়। একেকটি সাধারণ ঘরে ২০০ থেকে ৪০০ কেবি (কাঠ পরিমাপের একক) কাঠ প্রয়োজন হয়। তবে দোতলা ও তিন তলা ঘরে ৪০০ থেকে ১ হাজার কেবি পর্যন্ত কাঠের প্রয়োজন হয়।

তারা আরও জানান, এখন অধিকাংশ ঘরেই নাইজেরিয়ার তৈরি শক্ত লোহা কাঠ ব্যবহার করা হয়। প্রতি কেবি কাঠ ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা কেবি দরে কিনে আনেন ঘর ব্যবসায়ীরা।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, একসময় বার্মার লোহাকাঠ, শালকাঠ ও সাদা টিন দিয়ে এই ঘর নির্মাণ করা হতো। কিন্তু এখন বার্মার লোহা কাঠ পাওয়া না যাওয়ায় নাইজেরিয়া থেকে আমদানি করা লোহাকাঠ, সেগুন কাঠ ও টিন দিয়ে অধিকাংশ ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। এ জেলার দিঘিরপাড়, গৌড়দৌর, বালিগাঁও, মুন্সিরহাট, শ্রীনগর বাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে এসব কাঠ বিক্রির পাইকারি হাট।

লোহাকাঠ দিয়ে নির্মিত ঘরগুলো সাধারণত ৬০ থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে। হাটে একতলা ঘরগুলো ২ থেকে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত দামের বিক্রি হয়। দোতলা ও তিন তলা ঘরগুলো ১২ থেকে ৩০ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে অনেকেই বাড়িতে কাঠমিস্ত্রি এনে ২০ থেকে ৪০ লাখ টাকা ব্যয়েও দুই-তিনতলা প্রাসাদের মতো টিন ও কাঠ দিয়ে ঘর নির্মাণ করেন। সঙ্গে টিন ও প্লেনশিট দিয়ে তৈরি করা হয় বিভিন্ন নকশা, যা ঘরগুলোর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ।

রেডিমেড ঘর ব্যবসায়ীরা জানান, শুধু স্থানীয়রা নয়, আশপাশে বিভিন্ন জেলা থেকেও এসব ঘর কিনতে আসেন অনেকে। ঢাকা, মাদারীপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, কুমিল্লা, যশোর, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, টাঙ্গাইল এমনকি সিলেট, সুনামগঞ্জ, কক্সবাজারসহ দেশের অনেক জেলা থেকে লোক এসে এসব ঘর কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বজ্রযোগিনী ইউনিয়নের চূড়ামইন গ্রাম, মহাকালী ইউপির বাগেশ্বর গ্রাম, সুয়াপাড়া গ্রাম, রামপালের ধলাগাঁও গ্রাম, টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বেতকা, কালিবাড়ি, বালিগাঁও, কুণ্ডেরবাজার এলাকা, লৌহজংয়ের কলাবাগান কাঠপট্টি, সিরাজদিখানের মালখানগর, কুচিয়ামোড়া, বালুচরসহ একাধিক স্থানে গড়ে উঠেছে ঘর বিক্রির হাট।

লৌহজংয়ের কলাবাগান কাঠপট্টি এলাকার কাঠমিস্ত্রি প্রাণ গোপাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২৫ বছর ধরে ঘরের কাজ করি। দেড় তলা ও দোতলা ঘর বানাই। আগে ছিল বার্মার কাঠ, এখন সেই কাঠ ৫ হাজার টাকা কেবিও পাওয়া যায় না। নাইজেরিয়ার কাঠ ১২০০ টাকায় আগে পাওয়া গেলেও এখন ২২ থেকে ২৩০০ টাকা কেবি। এসব কাঠ অনেক ভালো। ৮০ থেকে ৯০ বছরেও কিছু হয় না।

বরিশাল খুলনা, যশোর, বরিশাল, পটুয়াখালী, সিলেট জেলার লোকজন এসে এসব ঘর কিনে নেয়। আমরা ট্রাকে করে ঘর নিয়ে গিয়ে তুলে (ফিটিং) দিয়ে আসি। আগে টিন ছিল সব সাদা, এখন মানুষ বলে লাল বা পাতা কালার দেবেন। কাঠ বুঝে একটি দোতলা ও তিনতলা ঘর ৩০, ২০ ও ১০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়, বলেন তিনি।

ঘর ব্যাবাসায়ী জসিমউদ্দিন বলেন, বর্তমানে ঘর কম চলতাছে। বাড়িতে পানি ওঠায় এ বছর বর্ষায় ঘর কম বিক্রি হয়েছে। এ দেশের পাশাপাশি কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, বগুরা, বরগুনা জেলাসহ পূর্ব অঞ্চলের জেলার লোকজন এসে কিনে নিয়ে যান। তার এখানে তৈরি  সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকায় একটি ঘর বিক্রি হয়।

এনএ