নুরুল আমিন (৬৫) ও তার স্ত্রী কামরুন নাহার (৬০)

নুরুল আমিন (৬৫) ও তার স্ত্রী কামরুন নাহার (৬০) দুজনই ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। স্বামী-স্ত্রী দুজনই ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সমাজসেবা কর্মকর্তা। বিভিন্ন সময় প্রায়ই তারা ব্যাংকে যাতায়াত করতেন। তাদেরকে নিজের রিকশা চড়িয়ে ব্যাংকসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতেন তাদের দীর্ঘ দিনের পরিচিত প্রতিবেশী রিকশাচালক মো. আব্দুল মালেক। 

ঘনঘন ব্যাংকে যাতায়াত করায় অনেক আগে থেকেই ছিঁচকে চুরির সঙ্গে জড়িত মালেক ওই দম্পতির ঘরে চুরির পরিকল্পনা করেন। পরে এই ছিঁচকে চোরের হাতেই নিজ বাড়িতে খুন হন ওই দম্পতি। তারা চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার নাওড়া এলাকা নিজ বাড়িতে বসবাস করতেন। তাদের এক ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে।

চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে চাঞ্চল্যকর নুরুল আমিন দম্পতি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন শেষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানিয়েছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার খন্দকার নূর রেজওয়ানা পারভীন। শনিবার (২৩ অক্টোবর) সন্ধ্যায় শহরতলী বাবুরহাট এলাকায় অবস্থিত পিবিআই কার্যালয়ে তিনি এসব কথা জানান।

ইতোমধ্যে এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত এক আসামিসহ তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শনিবার দুপুরে তাদেরকে কোর্টের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ।

গ্রেফতারকৃত আসামিরা হলেন- খুনের সঙ্গে জড়িত শাহরাস্তি উপজেলার ঘুঘুসাল এলাকার মো. আবদুল মালেক, চুরি যাওয়া মালামাল ক্রয়কারী আসামি ঝালকাঠি সদর উপজেলার গাবখান এলাকার মো. ইলিয়াস হোসেন ও বরিশাল জেলার কাউনিয়া উপজেলার চরবাড়ীয়া এলাকার মো. বশির। তারা উভয়েই চাঁদপুর শহরে থাকতেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

পুলিশ সুপার বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ২৯ জুন সন্ধ্যায় বাড়ির মূল গেইট খোলা পেয়ে মালেক ওই দম্পতির বাড়ির ছাদে কৌশলে অবস্থান নেয়। রাত ৯টার দিকে নুরুল আমিন ছাদে উঠলে পেছন থেকে খালেক তার সঙ্গে থাকা লোহার রড দিয়ে সজোরে তার মাথায় আঘাত করেন। তার পরিচয় প্রকাশ হওয়ার ভয়ে ছাদে শুকাতে দেওয়া পায়ের মোজা দিয়ে শ্বাসরোধ করে সেখানেই হত্যা করে তাকে। পরবর্তীতে চুরি করতে বিল্ডিংয়ের একটি রুমে ভেতরে প্রবেশ করে একটি ফাইল কেবিনেটের ড্রয়ার টানাটানি করতে থাকে।

এ সময় ড্রয়ার খোলার শব্দ শুনতে পেয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে মালেককে দেখে চিনে ফেলে কামরুন্নাহার। এটিই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। খালেক তার হাতে থাকা রড দিয়ে কামরুন্নাহারের মাথায় আঘাত করেন। এতে করে তিনি ফ্লোরে পড়ে যান। পরবর্তীতে নুরুল আমিনের ব্যবহৃত একটি অপো এ-৮৩ মডেলের একটি মোবাইল ফোন নিয়ে ছাদ থেকে গাছ বেয়ে নিচে নেমে পালিয়ে যায়। গত ১ জুলাই ঘরের তালা ভেঙে মৃত অবস্থায় নুরুল আলমের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

গ্রেফতার মো. আব্দুল মালেক

অজ্ঞান অবস্থায় তার স্ত্রী কামরুন নাহারকে উদ্ধার করে ঢাকায় পাঠানো হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনিও মারা যান। এই ঘটনায় নিহতদের ছেলে মো. জাকারিয়া বাবু বাদী হয়ে শাহরাস্তি থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন।

নূর রেজওয়ানা পারভীন বলেন, মামলাটি প্রায় এক মাস শাহরাস্তি থানা পুলিশ তদন্ত করে। পরবর্তীতে তদন্তাধীন অবস্থায় মামলার বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত এই মামলার পরবর্তী তদন্ত পিবিআইকে করার নির্দেশ দেয়। পরবর্তীতে পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক মো. কবির আহমেদ মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি বলেন, শুরু থেকেই এই ঘটনায় নিবিড়ভাবে তদন্ত কাজ চালু রাখি। এ ঘটনার ক্লু উদঘাটনে ব্যাপকভাবে কাজ করেছি। শাহরাস্তির প্রতিটি অঞ্চলে সন্দেহভাজন মানুষদের এই ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদ করি। বিশেষ করে এই ঘটনায় চুরি যাওয়া মোবাইল নিয়ে আগে থেকেই আমাদের নজরদারিতে চাঁদপুরের একজনকে রেখেছিলাম। পরবর্তীতে গোপন সোর্সের মাধ্যমে তাকে আমরা ফলো করতে থাকি।

আমরা নিশ্চত হই সেই সন্দেহভাজন ঝালকাটিতে রয়েছে। পরবর্তীতে চাঁদপুর থেকে পিবিআইয়ের একটি টিম পাঠিয়ে সেই সন্দেহভাজনকে ধরতে সমর্থ হই। ১৯ অক্টোবর ঝালকাঠি জেলার গাবখান এলাকা থেকে মো. ইলিয়াস হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। 

এ সময় তার কাছ থেকে চুরি যাওয়া মোবাইল সেটটি উদ্ধার করা হয়। এ সময় ইলিয়াস জানায়, মোবাইলটি চট্টগ্রামের ফুটপাতের একজন হকারের কাছ থেকে ক্রয় করেছেন, তবে তিনি তার নাম বলতে পারেনি। পরে তাকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে খোঁজ করে সেই হকার বশিরকে গ্রেফতার করা হয়। বশির জানায়, প্রায় দুই মাস আগে চাঁদপুরের শাহরাস্তি থেকে একজন এই ফোন সেটটি বিক্রি করতে এসেছিল। মোবাইলের দাম সাড়ে তিন হাজার টাকা দাবি করে। কিন্তু বশিরের কাছে এতো টাকা না থাকায় তার মাধ্যমে মোবাইল সেটটি ক্রয় করেন ইলিয়াস হোসেন।

পুলিশ সুপার বলেন, এই ঘটনায় পরে ২১ অক্টোবর আবদুল মালেককে গ্রেফতার করতে শাহরাস্তি, চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন কাঁচাবাজার আড়তে ও লাকসাম এলাকায় অভিযান চালানো হয়। আবদুল মালেক আত্মগোপনে থাকার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে ২২ অক্টোবর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে লাকসাম রেলওয়ে সংযোগের পাশে একটি বোর্ডিং থেকে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আবদুল মালেককে গ্রেফতার করা হয়। 

চাঁদপুর পিবিআই কার্যালয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি খুনের সব কিছু বিস্তারিত তুলে ধরেন। পরে তাকে নিয়ে শাহরাস্তি গিয়ে হত্যাকাণ্ডের আলামত উদ্ধার করা হয়। আবদুল মালেক অনেক আগে থেকেই এলাকায় ছিচকে চুরির সঙ্গে জড়িত ছিল। তার বিরুদ্ধে থানায় মামলাও রয়েছে বলে জানান তিনি।

এই ঘটনায় মামলার বাদী নিহত নুরুল আমিন দম্পতির ছেলে মো. জাকারিয়া বাবু বলেন, আমরা পিবিআইয়ের এই কার্যক্রমে অত্যন্ত খুশি। পুলিশ এভাবে মানুষের জন্য কাজ করতে তাদের প্রতি সাধারণের আস্থা ও ভালোবাসা আরও বৃদ্ধি পাবে। আমি প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। একই সঙ্গে আমার বাবা-মায়ের হত্যাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানাই।

শরীফুল ইসলাম/ওএফ