পিরোজপুরের নেছারাবাদ বা স্বরূপকাঠী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে নানা শিল্পের সমাহার। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা নানান শিল্পের কর্মযোগে মুখর থাকে সারা বছর।

নারকেলের বাম্পার ফলন হওয়ায় এই উপজেলায় গড়ে উঠেছে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে নানা জিনিস তৈরির কারখানা। ফেলে দেওয়া নারকেলের ছোবড়া সংগ্রহ করে মেশিনে দড়ি বানিয়ে তা থেকে তৈরি হয় ক্রিকেটের পিচ ম্যাট।

জানা যায়, ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে এই কার্যক্রম। বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলা শুরু হলে প্রথম দিকে পিচ না থাকায় বর্ষাকালে খেলাধুলা চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ত। পরে বিদেশ থেকে কৃত্রিম পিচ এনে ব্যবহার করা হতো ক্রিকেট খেলার জন্য। স্বরূপকাঠির একজন শিল্পী প্রথম নারকেলের ছোবড়াকে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে তৈরি করা শুরু করেন ক্রিকেটের পিচ।

প্রায় ৫০ বছর আগে ১৯৭২ সাল থেকে স্বরূপকাঠি উপজেলার সুটিয়াকাঠী ইউনিয়নের বেলতলা গ্রামে ছিল নারকেল ছোবড়াকেন্দ্রিক বিভিন্ন কুটিরশিল্পের কার্যক্রম। সেই শিল্পী স্থানীয় ইউপি সদস্য কাবারেক মিয়ার হাত ধরেই স্বরূপকাঠিতে শুরু হয় ক্রিকেট পিচ তৈরি। তখনকার দিনে কয়েকজন ব্যবসায়ীর হাত ধরে পশ্চিম পাকিস্তানসহ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ও জাতীয় দলের ইনডোর খেলাধুলার জন্য ব্যবহার করা হতো এই পিচ।

স্বরূপকাঠী উপজেলার সুটিয়াকাঠী ইউনিয়নের বেলতলা গ্রামের উঠতি শিল্পীরা তাঁতের শাড়ির মতো করেই তৈরি করেন এই পিচ। নারকেলের ছোবড়া থেকে চিকন সুতার সাহায্যে ৬৬ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৮ ফুট প্রস্থের আধা ইঞ্চি পুরু যে দড়ি ব্যবহার করা হয়, তাকে স্থানীয়ভাবে কাতরা বলা হয়। এর এক প্রান্তের কর্মী কাঠির মাথায় কাতরা রশি লাগিয়ে তা পৌঁছে দেন অন্য প্রান্তের কর্মীর হাতে। তিনি নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে টান দিলেই মিলে যায় দড়ি। তারপর আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে ক্রিকেট পিচ।

নারকেলের ছোবড়াশ্রমিক মো. মাছুম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে আমরা ছোবড়ার ব্যবসা করি। এটা দিয়ে পাপোশ হয়। ব্রাশের তুলি, দড়ি, পিট, চিকন কাতড়া হয়। ছোবড়ার গুঁড়ি মেহগনি, চাম্বল, মাল্টাসহ বিভিন্ন গাছের চারার গোড়ায় দিতে লাগে। মোটামুটি লাভ হয়। প্রতি বস্তা ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হয়। ডাব কেটে ফেলে সবাই। এ জন্য নারকেলের ছোবড়া পাওয়া যায় না।

আরেক শ্রমিক মিরাজ ব্যাপারী জানান, ভান্ডারিয়া, তুষখালীসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আমরা নারকেলের ছোবড়া আনি। এগুলো মেশিন দিয়ে আঁশ বানাই। আঁশ শুকাতে দিই আর গুঁড়িগুলো বস্তায় ভরে বিক্রি করি। ১৫০ থেকে ১৮০ টাকায় বস্তা বিক্রি হয়।

শ্রমিক চান মিয়া বলেন, একটি পিচ তৈরি করতে ৩ থেকে ৪ জন শ্রমিক লাগে। প্রতিদিন ৫০০ টাকা করে মজুরি পাই আমরা। ক্রিকেট বোর্ডসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হয় এগুলো। চরকায় সুতা তৈরির পর সেই সুতা থেকে ক্রিকেট পিচ বানানো হয়। এক সপ্তাহ লাগে একটি বানাইতে। দেশের বাইরে যায় কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় এগুলোর চাহিদা আছে।

শ্রমিক মো. হালিম হাওলাদার জানান, এই তো ৪০ বছর ধরে কাজ করছি মালিকের সঙ্গে। নারকেলের ছোবড়া থেকে আঁশ তৈরি হয় বাগেরহাটের কারখানায়। সেখান থেকে আঁশ ১৫০ টাকা কেজিতে কিনে এনে পাকিয়ে দড়ি তৈরা করা হয়।

দি পিপলস কয়ার ইন্ডাস্ট্রিজের মালিকের ছেলে হৃদয় আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথমত ছোবড়া থেকে মিলের মাধ্যমে আঁশ বের করা হয়। আঁশ থেকে রোপ তৈরি করে তারপর বুনিয়ে ম্যাট তৈরি হয়। ৩ থেকে ৪ জন শ্রমিক কাজ করেন একটি ম্যাট তৈরিতে। নারকেলের ছোবড়ার দামের ওপর নির্ভর করে পিচের দাম কেমন হবে এবং কতটা লাভ হবে।

তিনি বলেন, বর্তমানে করোনার কারণে কাঁচামালের দাম গত দুই বছরের চেয়ে দিগুণ। শ্রমিক খরচসহ ২৭ থেকে ২৮ হাজার টাকা খরচ হয় প্রতিটি পিচে। দুটি পিচ তৈরি করতে আমাদের এক সপ্তাহ লাগে। বিকেএসপি, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার ও তাদের ক্রিকেট মাঠ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর কাছ থেকে অর্ডার আসে। এই পিচ শুধু আমাদের এখানেই তৈরি হয়, অন্য কোথাও হয় না। আমাদের কাছে অর্ডার করলেই আমরা তৈরি করে দিই।

দি পিপলস কয়ার ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী মো. মহিউদ্দিন তোতা মিয়া বলেন, প্রায় ৪০ বছর ধরে এ কাজ করছি। বিসিবি থেকে নম্বর নিয়ে সবাই যোগাযোগ করে। গুলিস্তানে আমাদের কিছু এজেন্ট আছে, তারা আমাদের কাছ থেকে পিচ নেয়। লাভের বিষয়ে তিনি বলেন, এখন লাভ কম হচ্ছে, খরচ বেশি পড়ছে। ২৭ থেকে ২৮ হাজার টাকার মতো খরচ পড়ে। ৩৫ থেকে ৩৮ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। অনেক স্লো আইটেম। একটা ম্যাটে ৮ থেকে ১০ বছর চলে। বছরে প্রায় ৩৫টি ম্যাট বিক্রি হয়।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) জেলা উপব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) মিলটন চন্দ্র বৈরাগী ঢাকা পোস্টকে বলেন, পিরোজপুরের নেছারাবাদের নারকেলের ছোবড়ার সাহায্যে যে ক্রিকেটের পিচ তৈরি হয়, তা আমাদের দেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। এই শিল্প রক্ষার্থে বিসিক বিভিন্নভাবে ভূমিকা রাখছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রশিক্ষণ বাজেটের আওতায় মোট ৫০ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৫ শিল্প উদ্যোক্তাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ৪ শতাংশ সহজ সুদে ১ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। 

তিনি বলেন, বিসিকের কাছে সম্ভাবনাময় শিল্প উদ্যোক্তারা খুব সহজেই জামানতবিহীন ঋণসহায়তা পেয়ে থাকেন। এ বছর বিসিক শিল্প নগরী পিরোজপুরের স্বরূপকাঠীতে ৫ জন শিল্প উদ্যোক্তাকে ১৩টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্লটের চাহিদা থাকায় বর্তমানে জেলায় একটি বিসিক শিল্পনগরী গড়ে তোলা খুব জরুরি।

পিরোজপুর জেলা প্রশাসক আবু আলী মো. সাজ্জাদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে জানান, নেছারাবাদ উপজেলার নারকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি ক্রিকেট পিচ তৈরির বিষয়টি প্রশংসনীয়। উপজেলার অনেক মানুষ এ শিল্পে জড়িত আছে। তবে এর প্রসার ঘটলে আরও কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগ রয়েছে। এই শিল্পের উন্নয়নে আমাদের প্রচেষ্টা রয়েছে। আমরা বিসিকের মাধ্যমে কিংবা ব্যাংকের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের সল্প সুদে ঋণসুবিধা দেব।

এনএ