অর্ধেক শরীর নিয়ে জন্ম তার। নারীছেঁড়া ধনের এই শরীর দেখে রাজ্যের হতাশা ও অনিশ্চয়তা ভর করেছিল মা-বাবার চোখেমুখে। পাড়ার লোকে একনজর দেখতে এসে ভিড় করেছে, কতজনে কত কটু কথাই না বলেছে। তবে কারও কথার কোনো উত্তর করেননি তার মা-বাবা।

কিন্তু কে জানত, সমাজ, প্রকৃতি ও ভাগ্যের সঙ্গে লড়াই করে সেই শিশু একদিন বড় হয়ে উঠবে। অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে শারীরিক নানা প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে সেই শিশুটি এগিয়ে চলছে স্বপ্নপূরণের পথে।

বলছি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভবানীপুর নামাপাড়া গ্রামের আবেদা আঞ্জুম স্মৃতির কথা। পরিবারে দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। মা সুফিয়া খাতুন গৃহিণী। ভাইয়েরা কৃষিকাজ করেন। মায়ের অভাব-অনটনের সংসারেই তার বেড়ে ওঠা।

তিনি জন্ম নিয়েছিলেন দুই পা ছাড়াই। দেড় বছর বয়সে হারান বাবাকেও। মায়ের অভাব-অনটনের সংসারে বেড়ে ওঠা তার। যখন কিছুটা বুঝতে শিখেছেন, সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পড়াশোনা করার। মায়ের কোলে চড়ে বাড়ির পাশে কান্দানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করেন। সেখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ শেষে ভর্তি হন কান্দানিয়া কচুয়া বাজার দাখিল মাদরাসায়।

তবে তিনি হেরে যাননি জীবনযুদ্ধে। পা না থাকলেও হাতের তালুতে ভর করেই তিনি ছুটে চলেন। শুধু তা-ই নয়, নানাজনের কটাক্ষ উপেক্ষা করে একের পর এক বাধা পেরিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন পড়াশোনা, করছেন দৈনন্দিন কাজ।

জানা যায়, প্রতিদিন সকালে মা সুফিয়া খাতুন মেয়ে স্মৃতিকে কোলে করে বাড়ির পাশের সড়কে ভ্যান-রিকশায় তুলে দিতেন। মাদরাসা ছুটির পর আবার সড়কে গিয়ে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করতেন। এভাবে জেডিসি পরীক্ষায় জিপিএ-৪.৫০ এবং দাখিল পরীক্ষায় জিপিএ-৩.৯৪ পেয়ে পাস করেন স্মৃতি।

স্মৃতি এখন ভবানীপুর ফাজিল সিনিয়র মাদরাসায় দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছেন। বাড়ি থেকে কোমরে ভর করে হাতে হেঁটে মাটির রাস্তা পেরিয়ে বাকিটা পথ ভ্যানে করে তিন কিলোমিটার দূরের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যান স্মৃতি।

সোমবার (২৫ অক্টোবর) সরেজমিনে ভবানীপুর ফাজিল সিনিয়র মাদরাসায় দেখা যায়, ভ্যান থেকে নামার পরপরই স্মৃতির ব্যাগটি নিতে এগিয়ে আসেন এক সহপাঠী। তারপর সবাই মিলে এগিয়ে যান শ্রেণিকক্ষে। ক্লাস শেষে সহপাঠীদের সহযোগিতায় বেঞ্চ থেকে মাটিতে নেমে দুই হাতে ভর দিয়ে কমনরুমে যান স্মৃতি। শারীরিক এই প্রতিবন্ধিতার মধ্যেও তার মুখে সব সময় হাসি যেন লেগেই থাকে। মাদরাসা ছুটি হলে সহপাঠী কিংবা শিক্ষকরা আবার তাকে ভ্যান-রিকশায় তুলে দেন।

এমন জীবনসংগ্রামের গল্প ঢাকা পোস্ট জানতে চাইলে আবেদা আঞ্জুম স্মৃতি বলেন, ছোটবেলায় সবাই খেলাধুলা করলেও আমি পারতাম না। আমার খুব কষ্ট হতো এই ভেবে যে কেন আমি শারীরিকভাবে এমন হলাম। আমি ভালো থাকলে তো সবকিছু করতে পারতাম, সবার সঙ্গে খেলাধুলা করতে পারতাম। তবে স্বপ্ন দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার, নারী শিক্ষায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখার।

যদিও আমার পড়াশোনা শুরু করতে কয়েক বছর দেরি হয়েছে। কিন্তু আমি চেয়েছি পড়াশোনা করবই। পরিবারের সবার সহযোগিতা পেয়েছি। তবে আশপাশের মানুষ বলত, লেখাপড়া করে কী হবে। আরও অনেক কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু আমি থেমে যাইনি। কারণ, লেখাপড়া না করলে কোনো কিছু করা সম্ভব না। তাই অনেক কষ্ট হলেও আমি পড়াশোনা চালিয়ে গেছি।

দৌড় প্রতিযোগিতাও স্মৃতি প্রথম হয়েছিলেন, এমন মজার স্মৃতি মনে করে তিনি বলেন, আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় হয়েছিল। সেখানে আমি দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। তবে মজার ব্যাপার হলো, সেই প্রতিযোগিতায় হাত দিয়ে দৌড়েই আমি প্রথম স্থান দখল করেছিলাম। সেদিন আমার খুব আনন্দ লেগেছে। তখন আমার মনে হয়েছে, অন্যদের মতো আমাকে দিয়েও অনেক কিছুই হবে।

এত কষ্ট করে লেখাপড়া করছি কারণ আমার ইচ্ছা আছে চাকরি করব। আমি দেশের জন্য কিছু একটা করতে পারব, নারী শিক্ষায় অবদান রাখতে পারব, এমন স্বপ্ন নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি, যোগ করেন অদম্য এ স্মৃতি।

এ লড়াইয়ে অবশ্য ছায়া হয়ে পাশে আছে তার পরিবার, প্রেরণা দিচ্ছেন সহপাঠী ও শিক্ষকরাও। স্মৃতির মা সুফিয়া খাতুনের ভাষ্য, স্মৃতি যেসুমে অইছে, পাড়ার মাইনষে অবাক অইয়া গেছে। বাড়ি-ঘরো মানুষ আটছে না। ওর বাপ আমারে বুঝাইছে, আমি যাতে রাগ না করি। কইছে, তুমি স্মৃতিরে আদর করো। স্মৃতি না অইলে কি আমি এত্তুরি মানুষ দেখতাম?

তিনি আরও বলেন, আমি চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। তখন ছেলেরা ছোট ছিল। কিন্তু আস্তে ধীরে মানিয়ে নিয়েছি। স্মৃতি এখন অনেক কিছুই করতে পারে। ভালো করে পড়াশোনাও করছে। পরীক্ষায় ভালো ফলাফলও করেছে। পড়াশোনা করা নিয়ে মানুষজন অনেক টিটকারি করেছে, নানাজন নানা কথা বলেছে, কিন্তু আমরা সেসব কানে তুলিনি। স্মৃতি অনেক কষ্ট করছে। আমি চাই তার স্বপ্ন পূরণ হোক।

স্মৃতির ভাই ফখরুল ইসলাম বলেন, ছোটবেলায় যখন লক্ষ করলাম লেখাপড়ার প্রতি তার ব্যাপক আগ্রহ। তখন আমরাও আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু চেষ্টা করার তা করেছি। আর এত কষ্ট করে এতদূর এগিয়ে গেছে দেখে আমাদেরও অনেক ভালো লাগে।

ভবানীপুর ফাজিল সিনিয়র মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাওলানা মোবারক আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, লেখাপড়ার প্রতি স্মৃতির যথেষ্ট আগ্রহ আছে। পড়াশোনার ক্ষেত্রে আমরাও তাকে সহযোগিতা করে থাকি। পড়াশোনা করে একদিন সে চাকরি করবে এবং দেশ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করবে বলে বিশ্বাস করি। যারা সুস্থ-সবল এবং বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তান, তাদের স্মৃতির জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে ভালোভাবে পড়াশোনা করা উচিত।

এনএ