জীবিকা নির্বাহ করতে একেকজন একেক রকম পেশা বেছে নেন। তবে অনেকেই নেশা হিসেবে কোনো কাজ বেছে নিয়ে তা পেশায় পরিণত করেন। এমনই এক ব্যক্তির নাম আনোয়ার হোসেন (৫৫) । তিনি ইঁদুর ধরাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাকে দিয়ে অনেকেই বাড়ির কিংবা ক্ষেতের ইঁদুর ধরে মেরে নেন। বিনিময়ে দেন চাল অথবা টাকা। এ দিয়েই দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে চলে তার সংসার। 

আনোয়ার হোসেন জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর ভট্টপলাশী গ্রামের বাসিন্দা। তিনি প্রথমে ইঁদুর ধরাকে নেশা হিসেবে মেনে নিলেও পরে তা পেশায় পরিণত করেন। ঘরের আসবাবপত্র, কাপড় আর ক্ষেতের ফসলসহ সব কিছুতেই ভাগ বসিয়ে তা নষ্ট করা ইঁদুরকে ধরতে নানা কৌশল রপ্ত করেছেন আনোয়ার হোসেন। 

জানা গেছে, ১৯৯৫ সাল থেকে ইঁদুর ধরে আসছেন আনোয়ার হোসেন। ইতোমধ্যে জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযানে তিনি বেশ কিছু পুরস্কারও পেয়েছেন। ২০০৪ সালে ২৩ হাজার ৪৫১টি ইঁদুর মারার জন্য তিনি জাতীয় পর্যায়ে ঢাকার খামারবাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে পুরস্কার হিসেবে ১৪ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশন পেয়েছিলেন। এই ২৬ বছরে তার কাছে ইঁদুর ধরার কৌশল শিখেছেন ৫৭ জন। তাছাড়া ইঁদুর ধরার ফাঁদ বা ইঁদুর মারার ওষুধও বিক্রি করেন তিনি।

আনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাবা মানুষের বাড়িতে আমাকে কাজে রেখেছিলেন। সেখানে থেকে আমি গরু চরাতাম। গরু চরাতে গিয়ে দেখতাম ধান দিলে মুড়ির মোয়া দিত। তাই মাঠ থেকে ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে ধান বের করেছি। সেই ধান দিয়ে মুড়ির মোয়া খেয়েছি আর গরু চরিয়েছে।

একদিন আমার বাড়ির পাশে এসে এক কৃষি অফিসার আমাকে বলেন- আনোয়ার তুমি এতো ইঁদুর কীভাবে মারো? তখন আমি তাকে বলি মাটি খুঁড়ে মারি স্যার। তখন তিনি বলেন ইঁদুর মেরে মেরে লেজগুলো আমার কাছে জমা দিও। তাহলে তুমি পুরস্কার পাবে। তখন আমি চিন্তা করি এভাবে খুঁড়ে খুঁড়ে এতো ইঁদুর মারা সম্ভব নয়। তাই একজনের গাছ থেকে কলা চুরি করি। ওই গাছের কলার শাখা দিয়ে গর্ত করি এবং পাকা কলা মাথায় দিয়ে দেখি নতুন গর্ত দিয়ে ইঁদুর আসে। তখন থেকেই আমি ইঁদুর ধরি। এরপর অনেক কৌশল শিখেছি। অনেককে আমি শিক্ষা দিয়েছি। তারাও আমার মতো ইঁদুর ধরে জীবিকা নির্বাহী করে। এতোদিনে দুই-চার লাখ ইঁদুর মেরেছি। 

তিনি আরও বলেন, মেরে ফেলে দেওয়া ইঁদুরগুলোর লেজ কেটে কেটে কৃষি অফিসে জমা দিতাম। সেখান থেকে তারা চাল দিয়েছে, গম দিয়েছে, জমিতে ওষুধ দেওয়া মেশিন দিয়েছে। ঢাকা থেকে রঙিন টেলিভিশন দিয়েছে। এখন আর পুরস্কার দেয় না। কয়েক বছর তিন হাজার করে টাকা দিচ্ছে। এ বছরও ১৫শ টাকা পাইছি।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ঠাঁকুরপুর গ্রাম থেকে ইঁদুর ধরার কৌশল শিখতে আনোয়ারের কাছে এসেছেন মো. বিল্লাল (৪৫)। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার এক ভাই হেলাল উনার (আনোয়ার হোসেন) শিষ্য ছিলেন। তিনি আমাকে এখানে নিয়ে আসেন। এরপর আনোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি ওষুধ দেন, আমি সেগুলো বিক্রি করি। পরে দেখি এটি আমার জীবিকা নির্বাহের একটি উপায় হয়ে গেছে। এখন আনোয়ার ভাইয়ের কাছে ইঁদুর ধরার কৌশল শিখতে জয়পুরহাটে এসেছি। 

গত বছর সারাদেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ ইঁদুর নিধন করা হয়েছে। আর ইঁদুরের আক্রমণ থেকে প্রায় ৯০ হাজার মেট্রিক টন আমন ফসল রক্ষা করা হয়েছে। এই ইঁদুর নিধনে ভূমিকা পালন রেখেছেন আনোয়ার হোসেন। তাই তার প্রতি খুশি কৃষি বিভাগও। 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক বাবলু কুমার সূত্রধর ঢাকা পোস্টকে বলেন, আনোয়ার হোসেন ইঁদুর ধরাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন। কেউ তাকে চাল, গম, আটা বা টাকা দিয়ে ইঁদুর ধরে নেয়। তিনি ইঁদুর ধরার জন্য প্রাকৃতিকভাবে অনেক কৌশলও রপ্ত করেছেন। তিনি এর আগে সর্বোচ্চ ইঁদুর নিধনের জন্য পুরস্কৃত হয়েছিলেন। আবারও সর্বোচ্চ ইঁদুর নিধন করতে পারলে পুরস্কার পাবেন।

আরএআর