ইয়াসে খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় তখন থেকেই পানিতে ভাসছে সাতক্ষীরার প্রতাপনগর ইউনিয়ন। ইউনিয়নের ২২ গ্রামের ১৮ গ্রাম পানিবন্দি। জনপদের মধ্যদিয়ে চলছে জোয়ারভাটা। টানা পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে ডুবে থাকায় নিঃস্ব হয়েছেন এলাকার ঘের ব্যবসায়ীরা। ভিটেমাটি হারিয়ে এলাকা ছেড়েছেন অনেকে। কেউবা উঁচুস্থানে বাঁধের ওপর বসবাস করছেন। তবে দুর্ভোগ নিরসনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যকরী পদক্ষেপ নেই বলে অভিযোগ করছেন গ্রামবাসী। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, কাজটি তদরকি করছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়।

আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের দরগাতলা গ্রামের কানাই গাজীর ছেলে জাফর আলী গাজী। পানিতে ভেসে গেছে তার ছয় বিঘা মাছের ঘের। ভিটেবাড়িসহ তিন বিঘা জমি চলে গেছে নদীতে। পানিতে ভেসে যাওয়ার আগ মুহূর্তে দেড় লাখ টাকার মাছ ছেড়েছিলেন ঘেরে। বড় হলে মাছগুলো বিক্রি হতো ৩-৪ লাখ টাকায়।

জাফর আলী গাজী বলেন, ইয়াসের সময় নদীর বাঁধ ভেঙে যায়। ভিটেবাড়িসহ জমি, মাছের ঘের সব নদীতে চলে গেছে। আমার তিন বিঘা জমি এখন নদীতে। খুব করুণ অবস্থায় আছি। চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। এখানে আমার মতো ২০টি পরিবারের ঘরবাড়ি ভেঙে চলে গেছে নদীতে। কেউ বাঁধের ওপর বসবাস করছে আবার কেউ কেউ চলে গেছে অন্যত্র।

১৫ দিন আগে ঘরবাড়ি ভেঙে নদীতে চলে গেছে আফফান আলী গাজীর। পাঁচ কাঠা জমির ওপর নির্মিত বাড়িতে স্ত্রী হোসনে আরা, ছেলে আব্দুল আলীম, মেয়ে আম্বিয়া খাতুনকে নিয়ে বসবাস ছিল পারিবারটির। সব হারিয়ে এখন দিশেহারা তারা। 

আফফান গাজীর স্ত্রী হোসনে আরা বলেন, এখন দরগাতলা রাস্তার ওপর তাবু ঝুঁলিয়ে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে বসবাস করছি। রাস্তাঘাট নদীতে চলে যাওয়ায় ছেলে-মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ঠিকেতো খেতেও পারি না। সামান্য কিছু ত্রাণ চাল, ডাল, আলু, তেল পেয়েছিলাম। সেগুলোতে কত দিন চলবে? জমি ও ঘরবাড়ি নদীর মধ্যে চলে যাওয়ায় কোথায় যাব আর কোথায় থাকব তার কোনো সিদ্ধান্ত এখনও নিতে পারিনি। দিশেহারা হয়ে গেছি।

ভিটেবাড়ি হারিয়ে এখন প্রতাপনগর ছেড়ে খুলনার রূপসায় পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করছেন ফারুক হোসেন। তিনি বলেন, দেড় বিঘা জমিসহ ঘরবাড়ি নদীতে চলে গেছে। কোনো চিহ্ন নেই। নিরুপায় হয়ে এলাকা ছেড়ে এখন খুলনায় বসবাস শুরু করেছি। এলাকায় থাকতে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়েছে। এখানে এসে ভ্যান চালাচ্ছি। জায়গা-জমি সব হারিয়েছে, যদি কোনো দিন এলাকায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ হয় সেদিন ফিরে যাব। ওই এলাকা এখন বসবাসের উপযোগী নয়।


 
আশাশুনি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, প্রতাপনগর ইউনিয়নে মাছের ঘের রয়েছে ১ হাজার ৪৭৭টি। এর আয়তন ১ হাজার ৫৩০ হেক্টর। চাষির সংখ্যা ১ হাজার ৩০০ জন। 

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সৈকত মল্লিক জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আম্পান ও ইয়াসের পর থেকে এলাকার কোনো ঘের ব্যবসায়ী মাছ চাষ করতে পারেনি। খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ ভেঙে গোটা ইউনিয়ন প্লাবিত। গ্রামের মধ্যদিয়েই ওঠানামা করছে নদীর জোয়ারের পানি। এ অঞ্চলের মাছের ঘেরগুলোর বেড়িবাঁধও নষ্ট হয়ে গেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘের মালিকরা। শুধু মাছ চাষিরাদের ১৫ কোটি ৩০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। 

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান জানান, চলতি বছরের ২৬ মে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইয়াসের সময় আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের বন্যতলা এলাকায় খোলপেটুয়া নদীর ৮০ মিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। বাঁধটি সংস্কারের জন্য কাজ করছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর। এ বিষয়ে অগ্রগতির বিষয়টি তারা বলতে পারবেন।

প্রতাপনগর গ্রামের বাসিন্দা সাইদুর রহমান জানান, ইয়াসের পর যখন বাঁধটি ভেঙে গেল তারপর থেকে বাঁধটি সংস্কার করা হয়নি। এরপর গ্রামের মধ্যদিয়ে নদীর জোয়ারভাটা শুরু হয়। একে একে ভেসে যায় বসবাসের ঘরবাড়ি, নদীতে চলে যায় কৃষি জমিগুলো। বাঁধটি মেরামত করলে হাজার হাজার মানুষ এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। কাউকে এলাকা ছাড়তে হতো না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দাতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে বন্যতলা এলাকার বাঁধটি সংস্কার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ফেনী জেলার সালেহ আহম্মেদ নামে এক ঠিকাদার বাঁধ মেরামত কাজটি বাস্তবায়ন করছেন। প্রকল্পের ব্যয় ৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।

সাহেল আহম্মেদ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক পার্টনার জাকির হোসেন জানান, ইয়াসের এক সপ্তাহ আগে আমরা বাঁধ মেরামতের ওয়ার্ক অর্ডারটি পেয়েছিলাম। তবে এখন সেখানে নির্মাণ করতে হচ্ছে ক্লোজার। যে টাকা বরাদ্দ ছিল সেই টাকায় ক্লোজার সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। সে কারণে কাজটি করতে দেরি হয়েছে। তবে এটি মেরামত করতে না পারায় এলাকার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন অভিযোগ সঠিক নয়। 

দাতা সংস্থা জাইকার বন্যতলা বেড়িবাঁধ সংস্কার প্রকল্পের কনসালটেন্ট আব্দুল মালেক জানান, জাইকার অর্থায়নে বাঁধ মেরামত কাজটি চলমান রয়েছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে কাজটি শেষ হবে বলে আশা করছি। 

বাঁধ সংস্কার কাজটি গত ছয় মাসেও শেষ হয়নি কেন? সমস্যা কোথায় ছিল? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ঠিকাদার নিয়োগ করা হলেও বৃষ্টি থাকায় ঠিকাদার কাজটি শুরু করতে দেরি করেছেন। সে কারণে কাজটি শেষ করা যায়নি। তবে সংস্কারের আগেই এলাকার মানুষ অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। 

এসপি