কেউ নাম তালিকাভুক্ত করছে, কেউ ওজন মাপছে, আবার কেউ দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা করছে। অ্যাপ্রোন, ওজন মিটার, উচ্চতা মাপার স্কেল বা ফিতা ও দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষার চার্ট (আই চার্ট) বিদ্যালয় থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। ১৮ সদস্যের ‘ক্ষুদে ডাক্তার’-এর দলটির সদস্যরা শিক্ষার্থীদের মাঝে স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধির ও স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।

এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে নওগাঁ সদর উপজেলার হাপানিয়া শহীদ সামাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সোমবার (১ নভেম্বর) শুরু হয়েছে বিদ্যালয়ে নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া। বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ‘ক্ষুদে ডাক্তারের’ এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মূলত সহপাঠী ও ছোটদের মাঝে স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত জ্ঞান ছড়িয়ে দিতেই এমন উদ্যোগ।

জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের যৌথ উদ্যোগে সারা দেশে ‘ক্ষুদে ডাক্তার’ এ কর্মসূচি চলছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার একটি অংশ হচ্ছে ফাইলেরিয়াসিস (একপ্রকার পরজীবী রোগ) নির্মূল ও কৃমি নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম। বিদ্যালয়ে কৃমি নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে জোরদার করার লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে ২০১১ সাল থেকে উদ্ভাবন করা হয় এই ক্ষুদে ডাক্তার কার্যক্রম।

বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৮৬ জন। এর মধ্যে ছাত্র ৯১ জন এবং ছাত্রী ৯৫ জন। তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতি শ্রেণিতে ৬ জন করে ১৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ক্ষুদে ডাক্তারের দল গঠন করা হয়েছে। প্রতি শ্রেণিতে ৬ জনের মধ্যে ৩ জন ছাত্রী রয়েছে। ক্ষুদে ডাক্তার বানাতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে তুলনামূলক যারা বড় ও বুদ্ধিমান, তাদের।

প্রতিবছরের জানুয়ারি ও জুলাই মাসে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। এ ছাড়া ছয় মাস পরপর কৃমি নিয়ন্ত্রক ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়। করোনাভাইরাসের মধ্যে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গত ২৩ অক্টোবর থেকে ২৯ অক্টোবর ওজন, উচ্চতা ও দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা করা হয়। পরে শিক্ষার্থীদের তালিকা প্রণয়ন ও সংখ্যা নির্ণয় করে তা নির্ধারিত ফরমে লিপিবদ্ধ ও বিদ্যালয়ে সংরক্ষণ করা হয়। ৩০ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে কৃমি সপ্তাহ। চলবে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত।

এ উদ্যোগের কারণে বিদ্যালয়গুলোতে স্বাস্থ্যসেবায় আরও এক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছে। এই কার্যক্রম খুবই ফলপ্রসূ বলে মনে করছে সচেতন মহল।

তারা বলছেন, শিশুদের স্বাস্থ্যসচেতন করে তুলতে এ কার্যক্রম খুবই ফলপ্রসূ। পাশাপাশি রোগজীবাণু সম্পর্কে ধারণা ও ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা হাতে-কলমে শিক্ষা পাচ্ছে তারা। ক্ষুদে ডাক্তাররা স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারা স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন করার পাশাপাশি মানুষের প্রতি সহমর্মিতা ও ভালোবাসা এবং প্রকৃত সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে প্রকৃত ডাক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশ ও জনগণের সেবায় এগিয়ে আসবে।

পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী ক্ষুদে ডাক্তার মায়া বানু, মাইশা, জিহাদুর রহমান ও জিহাদ হোসেন বড় হয়ে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। তারা বলে, যখন সাদা পোশাক গায়ে দিই, তখন নিজেকে ডাক্তারের মতো মনে হয়। আমরা নিজেরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি সহপাঠী ও ছোটদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার পরামর্শ দিই। আমরা কেউ ওজন মাপি আবার কেউ উচ্চতা। আবার কেউ দৃষ্টিশক্তি ঠিক আছে কি না দেখি। সেসব আবার খাতায় লিখে হেড ম্যাডামে কাছে জমা দিই।

হাপানিয়া শহীদ সামাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহানা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশুকে উন্নত জীবনের স্বপ্নদর্শনে উদ্বুদ্ধ করা। ক্ষুদে ডাক্তারের উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশুরা ভবিষ্যতে বড় হয়ে ডাক্তার হবে, মানুষকে সেবা দিতে উৎসাহী হবে। এখান থেকেই তাদের মানসিকতার উন্নয়ন হবে। ওজন, উচ্চতা ও দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা এবং নিয়মিত কৃমিনাশক ট্যাবলেট খাওয়ানো, সেবামূলক এই মনোভাব তৈরি করাই ক্ষুদে ডাক্তারদের উদ্দেশ্য।

তিনি আরও বলেন, এ কার্যক্রমের মাধ্যমে বোঝা যায় শিশুরা ঠিকমতো বাড়ছে কি না, তার ওজন ঠিক আছে কি না। সমস্যা হলে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলি। সে অনুযায়ী শিশুকে পুষ্টিকর খাবার ও বেশি খাবার দেওয়ার পরামর্শ দিই। তবে এখন পর্যন্ত দৃষ্টিশক্তির সমস্যার কোনো শিক্ষার্থী পাওয়া যায়নি।

নওগাঁ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবুল কালাম আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্ষুদে ডাক্তারদের কিছু স্বাস্থ্য শিক্ষা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সচেতনতা বিষয়ে ধারণা দেওয়া হয়। এরপর তারা তাদের সহপাঠী ও ছোটদের সঙ্গে সেসব বিষয়ে আলোচনা করে। ক্ষুদে ডাক্তাররা নিজেরা সচেতন হবে এবং অন্যদের সচেতন করবে। ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে কৃমিমুক্ত করা ক্ষুদে ডাক্তারদের উদ্দেশ্য।

এনএ