পরিবারের সঙ্গে মো. সেলিম

কবি জসীমউদদীনের কবিতার আসমানীদের ঘরের মতোই একটু বৃষ্টি হলেই পানি গড়িয়ে পড়ে সেলিমদের ঘরে। আসমানীদের তবু নিজের ভিটে থাকলেও, ১১ বছর ধরে সেলিম (৩২) পরিবার নিয়ে থাকেন অন্যের ভাঙা কাছারি ঘরে। এই কনকনে শীতের রাতে বিত্তবানরা যেখানে চার দেয়ালের মাঝে থেকেও কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমান, সেখানে তাদের সঙ্গী বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢোকা ঠান্ডা বাতাস।

সেলিম পেশায়  অটোরিকশাচালক। পৈতৃক বাড়ি রামগতি হলেও জন্ম ও বেড়ে ওঠা নানার বাড়ি ইয়াকুবপুরের ইসলামপুর গ্রামে। ২০০৯ সালে মা-বাবা ও এক ভাই মিলে নানার বাড়ির সম্পত্তি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যান। সেই থেকে তার ঠিকানা হয় লাল মিয়া পাটোয়ারি বাড়ির মর্তুজা মিয়ার কাছারি ঘরে।

সেলিমের এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে সিয়াম পঞ্চম শ্রেণিতে আর মেয়ে নুহার বয়স চার বছর। ছেলের পড়ালেখার খরচও ঠিকমতো চালাতে পারেন না। স্ত্রী রোকেয়া বেগম একজন গৃহিণী (২৫)। শ্বশুরবাড়ি একই উপজেলার তুলাতলি গ্রামে। তাদের অবস্থা ভালো না হওয়া মেয়ের জামাইয়ের পাশে দাঁড়াতে পারেন না।

সেলিমের নিজের ঘর নেই। তাই বিদ্যুৎ-সংযোগ পাননি। নেই কোনো স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন-ব্যবস্থা। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, ঠান্ডায় কেঁপে, বিদুৎবিহীন অন্ধকার ঘরে মানবেতর দিনাতিপাত করছেন ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার ইয়াকুবপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. সেলিম।

সেলিম যদি ঘর করে দেওয়ার জন্য আবেদন করেন, তাহলে উপজেলা প্রশাসন বিষয়টি বিবেচনায় নেবে। সরকারি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তার জমিতে ঘর তুলে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।

নাহিদা আক্তার তানিয়া, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা

যে ঘরে থাকেন সেলিম, সেই ঘরের বয়স ৭০ বছর! বৃষ্টির দিনে টিনের ছিদ্র দিয়ে পানি ঢোকে। প্রতিবছর কিছুটা মেরামত করলেও তেমন কাজ হয় না। বৃষ্টি বেশি হলে বেড়ার ফাঁক দিয়েও পানি ঢোকে। ঝড়ের রাতে তো প্রাণ হাতে নিয়ে বসে থাকতে হয়। ভয়! কখন জানি ঘর ভেঙে পড়ে। আর শীতকালে বাঁশের বেড়া দিয়ে বাতাস ঢোকে। তবু উপায় নেই, আর যে যাওয়ার কোনো ঠিকানা নেই। নেই শীত নিবারণের কোনো কাপড়ও। এসব নিয়ে তাদের বাস।

২০১৯ সালে কিস্তিতে টাকা নিয়ে একটি অটোরিকশা কেনেন। দৈনিক ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়। কিন্তু আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সংকুলান হয় না। সংসার চালানো, রিকশার মেরামত― এসব করতে করতে আর ঘর করার সামর্থ্য হয়ে ওঠে না। প্রতিবছর ৩২ হাজার টাকা লাগে রিকশার ব্যাটারি বদলাতে কিন্তু সে অনুযায়ী আয় নেই। আয়-ব্যয়ের সমীকরণ না মেলাতে পেরে দারিদ্র্যের জাঁতাকলে পৃষ্ঠ হয়ে অন্যের ভাঙা ঘরেই থাকতে হয় তাদের।

প্রায় ৭০ বছরের জরাজীর্ণ ঘরে ঝুঁকি নিয়ে বাস করতে হচ্ছে

এ ব্যাপারে সেলিম জানান, ২০২০ সালে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে এবং আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতায় দুদমুখা বাজারের পশ্চিম পাশে ৫ শতাংশ জায়গা কেনেন। জায়গা নিলেও টাকার অভাবে ভিটা বেঁধে ঘর করতে পারছেন না। আগেই ঋণগ্রস্ত হওয়ায় এখন আর কারও কাছে চাইতেও পারছেন না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কখনো কোনো রকম সাহায্য করেননি বলে জানান তিনি। কয়েকবার চেয়েও কোনো ধরনের সহযোগিতা না পাওয়ায় এখন আর চান না তাদের কাছে।
 
প্রতিবেশী করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেলিম তার পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। যেই ঘরে থাকেন, এটি প্রায় ৭০ থেকে ৮০ বছরের পুরোনো। এটি এখন বসবাসের উপযোগী না। আমরা জনপ্রতিনিধিদের কাছে তার বিষয়টি জানিয়েছি কিন্তু কোনো ফল পাইনি। সবার প্রতি অনুরোধ, তার পাশে দাঁড়িয়ে তার মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু করে দেবেন।

এ ব্যাপারে দাগনভূঞা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদা আক্তার তানিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেলিম যদি ঘর করে দেওয়ার জন্য আবেদন করেন, তাহলে উপজেলা প্রশাসন বিষয়টি বিবেচনায় নেবে। সরকারি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তার জমিতে ঘর তুলে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।

এনএ