ফাইল ছবি

আজ ২৭ জানুয়ারি, বুধবার। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৫ সালের এই দিনে হবিগঞ্জ সদর উপজেলা বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় তিনিসহ পাঁচজন নিহত ও শতাধিক লোকজন আহত হন। হত্যাকাণ্ডের সাড়ে ৯ বছর পর সম্পূরক চার্জশিট দাখিলের মাধ্যমে বিচার কাজ শুরু হলেও বিচার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন নিহতের স্বজনরা। 

জানা গেছে, ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি বিকেলে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে ঈদ পরবর্তী এক জনসভা শেষে ফেরার পথে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন তৎকালীন হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ পাঁচজন। আহত হন কমপক্ষে শতাধিক নেতাকর্মী।

এ ঘটনার রাতেই হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বর্তমান হবিগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল মজিদ খান বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তে কাজ করে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু মামলার স্বাভাবিক তদন্ত না হয়ে চলতে থাকে দলীয় বিবেচনায়।

সিআইডির তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান মামলাটি তদন্ত করে ১০জনের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২০ মার্চ প্রথম অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্র দেওয়ার পর মামলার বাদী অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান ২০০৬ সালের ৩ মে সিলেট দ্রুত বিচার আদালতে নারাজি আবেদন করেন। আদালত তার আবেদন খারিজ করলে ১৪ মে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন। 

আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সরকারের প্রতি ‘কেন অধিকতর তদন্ত করা যাবে না’ মর্মে রুল জারি করেন। এই রুলের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের ১৮ মে লিভ টু আপিল করে সরকার। আপিল বিভাগ সরকারের আপিল খারিজ করেন। এরপর ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এ মামলার অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলামকে। 

দীর্ঘ তদন্ত শেষে তিনি ২০১১ সালের ২০ জুন আরও ১৪ জনকে আসামি করে এই আলোচিত মামলার অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্র দাখিল করেন। কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের সাড়ে ৬ বছর পর লুৎফুজ্জামান বাবর, মুফতি হান্নানসহ ২৪ জনকে আসামি করে অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছিল। 

২০১১ সালের ২৮ জুন কিবরিয়ার স্ত্রী আসমা কিবরিয়া চার্জশিটের ওপর হবিগঞ্জ জুডিসিয়াল আদালতে নারাজি আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলার মূল নথি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে থাকায় বিচারক রাজিব কুমার বিশ্বাস উপনথির মাধ্যমে আবেদনটি সিলেটে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি হত্যাকাণ্ডের অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্রের নারাজি আবেদন গ্রহণ করেন সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক দিলীপ কুমার বণিক। তিনি সিনিয়র পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে মামলার অধিকতর তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন।

এরপর সিআইডির এএসপি মেহেরুন নেছা দীর্ঘ তদন্ত শেষে সাড়ে ৯ বছর পর ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রোকেয়া আক্তারের আদালতে কিবরিয়া হত্যা মামলার তৃতীয় সম্পূরক অভিযোগপত্রে নতুন ১১ জনকে অন্তর্ভূক্ত করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। 

অন্তর্ভুক্ত আসামিরা হলেন- সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জি কে গউছ, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি তাজউদ্দিন, মুফতি সফিকুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, বদরুল, মহিবুর রহমান, কাজল আহমেদ, হাফেজ ইয়াহিয়া। 

এরপর ২০১৫ সালের জুনে মামলাটি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করা হয়। এরপর থেকে সেখানে বিচার কার্য শুরু হয়েছে। চলছে সাক্ষ্যগ্রহণ। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ৪৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। 

৩২ আসামির মধ্যে অন্য একটি মামলায় ৩ আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এখন ২৯ জন আসামি রয়েছে। এর মধ্যে জামিনে আছে ১২ জন। পলাতক ৭ জন এবং হাজতে আছে ১০ জন।

নিহত আবুল হোসেনের স্ত্রী আছিয়া আক্তার জানান, দেখতে দেখতে ১৬ বছর ধরে বিচারের জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু বিচার হচ্ছে না। বর্তমান সরকারের আমলে বিচার না হলে বিচার পাব কিনা সন্দেহ আছে। 

আবুল হোসেনের মেয়ে লিজা আক্তার জানান, আমার বাবা নেই ১৬ বছর ধরে। আমার বাবা ছিলেন আওয়ামী লীগের নিবেদিত প্রাণ। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিচার না হলে কখন হবে বিচার? অর্থের অভাবে তাদের লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না। অনেক কষ্টা করে তাদের সংসার চালাতে হচ্ছে। 

মামলার বাদী অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান এমপি জানান, আসামিদের অনুপস্থিত ও সাক্ষীদের সময়মতো হাজির করতে না পারায় মামলার কার্যক্রম বিলম্ব হচ্ছ। আমি বাদী হিসেবে হতাশ নয়, আমি আশাবাদী বর্তমান সরকারের আমলেই বিচার হবে এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে বাংলার মাটি কলঙ্কমুক্ত হবে। 

সিলেট বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট সারওয়ার আহমেদ চৌধুরী আব্দাল জানান, সাক্ষীদের অনুপস্থিতি ও আসামিদের হাজির করতে না পারায় সাক্ষ্যগ্রহণে বিলম্ব হচ্ছে। যে কারণে মামলার বিচার বিলম্ব হচ্ছে। 

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন সাক্ষীর বিরুদ্ধে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। তারা সময়মতো আসলেই দ্রুতগতিতে বিচার চলবে। আমরা আশাবাদী এ সরকারের আমলেই বিচার হবে এবং প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি পাবে। 

মরহুম শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়া জানান, দাখিলকৃত চার্জশিট মিথ্যা।আমরা জানিয়ে আসছি বার বার। সুষ্ঠু তদন্ত না হলে সুষ্ঠু বিচার হবে না। আমরা বিশ্বাস করি বাংলার মাটিতে একদিন কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে এবং দোষীদের শাস্তি দেওয়া হবে। 

মোহাম্মদ নুর উদ্দিন/এসপি