সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা, নদীমাতৃক জন্মভূমি প্রিয় স্বদেশের ছবি। লাল-সবুজের বুকে পাখির ছবি, দেশের মাটি ও মানুষের হাস্যোজ্জ্বল ছবি। পাখির সঙ্গে উড়তে চাওয়া, পদ্মফুল আর পদ্মপাতার বৃষ্টি ঠেকানোসহ কত মনোরম ছবি। যে ছবিগুলো দেখলে মনে হবে আপনি নিজেই সেখানে অবস্থান করছেন।

এমন ৪০টি ছবির একক প্রদর্শনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের তরুণ আলোকচিত্রী আসাদ-উদ-দৌলার হাত ধরে আবারও এল বিরল সম্মান। ইতালির ভ্যাটিক্যান সিটির সেন্ট পিটারস স্কোয়ারে গত ৩১ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর ১০ দিনব্যাপী চলে সেই প্রদর্শনী। ‘ইমোশন টু জেনারেট চেঞ্জ’ (Emotion To Generate Change) শিরোনামে ওই প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করেছিলেন দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস।

আলোকচিত্রী আসাদ-উদ-দৌলা জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর পৌরসভার শান্তা গ্রামের মো. সামছুল আজমের ছেলে। বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করা আসাদ বর্তমানে বগুড়ায় রুরাল ডেভেলপমেন্ট একাডেমীতে আলোকচিত্রী হিসেবে কর্মরত আছেন।

তার বাবাও ছিলেন একজন আলোকচিত্রী। সে সময় ফিল্ম ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা হতো। তাই বাবার ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে গিয়ে বকুনি খেতেন। তারপর নিজের মধ্যে আসে জেদ আর শখ। সেই শখ থেকেই ছবি তোলার নেশা এবং পরে পেশা হিসেবে বেছে নেন প্রিয় শখকে। যে পেশা দিয়ে বিশ্বের মাঝে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশকে।

বিশ্বের মানুষের কাছে দেশের সৌন্দর্য তুলে ধরতে পেরে অনেক খুশি আসাফ। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমার বাবা ছিলেন একজন আলোকচিত্রী। তার কাছ থেকে ফটোগ্রাফির বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করি। বাবা ফিল্ম ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতেন। তার ছবিগুলো আসাকে আকর্ষণ করে। তখন থেকেই আমি সিদ্ধান্ত নিই ছবি তোলার।

বাবার বকুনিতে তার ক্যামেরায় হাত না দিয়ে ২০০৮ সালে আমার মামার দেওয়া একটি মোবাইল ফোনের ১.৩ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা দিয়েই ছবি তোলা শুরু করি। যা ভালো লাগত তা-ই তুলতাম। তখন বুঝতে পারিনি যে কী তুলছি। কোনটা ইমেজ ও ফটোগ্রাফ। পরে বিভিন্ন ওয়ার্কশপে বা বড় ভাইদের সঙ্গে ফটোওয়ার্কে যাই। তখন বিস্তারিত জানতে পারি। এর মধ্যে কিছু ছবি আছে ল্যান্স কেপ, আর্কিটেকচার, স্টিল লাইভ।

তিনি বলেন, আমি গ্রামীণ ও শহরের মানুষের জীবনযাত্রা এবং প্রকৃতি ও রূপবৈচিত্র্য আমার ক্যামেরায় তুলে ধরার চেষ্টা করি। এরপর ২০১২ সালে প্রথম সেমি এসএলআর ক্যামেরা কেনার পর শুরু হয় অনলাইনে পড়াশোনা, বিভিন্ন ওয়ার্কশপ করা, সিনিয়র ফটোগ্রাফারদের সঙ্গে ছবি তোলা শেখা। ২০১৪ সাল থেকে ছবির প্রদর্শনী এবং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ শুরু করি। তারপর থেকে একের পর এক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি, বিশ্বের কাছে স্বদেশকে তুলে ধরেছি। এর মধ্যে অন্যতম হলো ইতালির মিলানে অনুষ্ঠিত মিলান এক্সপো। যেখাতে ২০১৫ সালে আমার ৮টি ছবি ছয় মাস ধরে প্রদর্শিত হয়।

তিনি জানান, ২০১৭ সালে কাজাখস্তান এক্সপো, সেখানেও তিন মাসব্যাপী ছবি প্রদর্শিত হয়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ইতালির ত্রেন্তো শহরে যাই রিলিজিওন টুডে ফিল্ম ফেস্টিভাল ২০১৮-তে যোগদান করতে। সেখানে ‘স্পিরিট অব ফেইথ’ নামক একক প্রদর্শনীর মাধ্যমে ১২ দিনব্যাপী ৩৩টি ছবি দিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরি। সেখানে ফটোগ্রাফার অব দি ইয়ার ২০১৮ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হই। 

২০১৯ সালে আসাফ যোগ দেন নেপালের সপ্তম হিউমান রাইটস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। সেখানে তার ছবির প্রদর্শনীতে সারা বিশ্বের বিস্ময় বাংলাদেশের অপার সৌন্দর্য তুলে ধরেন। ২০২০ সালের শুরুতে ভারতের অরুণাচলে বাটারফ্লাই ফেস্টিভ্যালে ও তার একটি একক প্রদর্শনী করেন। সর্বশেষ গত ৩১ অক্টোবর ইতালির ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার'স স্কোয়ারে তার ৪০টি ছবি প্রদর্শিত হয়।

আসাফ চেয়েছেন নতুন প্রজন্ম যেন খারাপ নেশায় আসক্ত না হয়ে আলোকচিত্রের মতো একটা সুস্থ নেশায় আসক্ত হয় এবং নিজের দেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারে।

আসাফের বাবা সামছুল আজম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমিও একসময় ছবি তুলতাম। সে সময় এই ছেলে ক্যামেরা নাড়াচাড়া করত। তখন ক্যামেরা নাড়তে দিতাম না। তারপর সে ছবি দেখে দেখে প্রলুব্ধ হয়। এরপর শখ থেকে ছবি তোলা নেশা হয়। আসাফ মোবাইল দিয়ে ছবি তুলতে তুলতে টিফিনের টাকা জমিয়ে একটি ক্যামেরা কেনে। তারপর ছবি তোলা শুরু। দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে ও দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিভিন্ন দেশে প্রতিযোতায় অংশ নিয়ে সে অ্যাওয়ার্ড নিয়ে আসে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সম্মান বয়ে নিয়ে এসেছে। আমার ছেলের মাধ্যমে আমিও পরিচয় লাভ করি। বাবা হিসেবে আমিও খুব গর্বিত।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের  চিত্রকলা, প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সুজন সেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফটোগ্রাফি শিল্পে বাংলাদেশে যে ধারা অব্যাহত রয়েছে, আমরা সেদিক থেকে খুব আশাবাদী। আজ বিশ্বদরবারে আলোকচিত্রী শিল্পীদের এই প্রয়াস সুন্দর অবস্থান নিয়েছে। আমরা মনে করি বাংলাদেশের এই চিত্রগুলো ফুটে উঠবে বিশ্বদরবারে। যা বাংলাদেশকে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক জায়গায় নেবে।

এনএ