ছোটবেলায় বাবার বাড়িতে ঘানি টানতেন। বড় হয়েছেন। বিয়ে হয়েছে। স্বামীর বাড়িতে আসার পরও ঘানি টানতে হয়েছে। এখনো একই পেশায় আছেন। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ সরিষা কিনে নিয়ে আসে সুফিয়ার কাছে। পরে সেই সরিষা ভাঙিয়ে তেল করে দেন তিনি। ৫ কেজি সরিষা ভাঙাতে তিনি নেন ১০০ থেকে ১২০ টাকা। তবে বয়সের ভারে এখন আর ঘানি টানতে পারেন না বৃদ্ধা সুফিয়া বেওয়া (৬০)। অসুস্থতা আর অভাবে তার জীবন হয়ে উঠছে বিষাদময়।

টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের জোত আতাউল্লা গ্রামের মৃত রজব আলীর স্ত্রী সুফিয়া বেওয়া। তার দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলে ঢাকায় কাজ করেন। তবে ছেলেরা মায়ের খোঁজখবর নেন না এবং ভরণপোষণও দেন না।

এর মধ্যে এক মেয়ের শিশু সন্তানকে লালন পালন করতে হয় তাকে। খেয়ে না খেয়ে কোনো রকমে সংসার চলছে সুফিয়ার। তবে হতদরিদ্র সংগ্রামী সুফিয়া বিধবা বা অন্য কোনো সরকারি ভাতা পাননি।

প্রত্যন্ত ওই গ্রামের বেপারীপাড়ায় একসময় প্রতি পরিবারেই ছিল ঘানি। তখন ঘানির শব্দে মুখর থাকত পুরো বেপারীপাড়া। তবে ‘ক্যাঁচ ক্যাঁচ’ শব্দ এখন আর নেই। কারণ এ পেশা বদল করে ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছেন সবাই।

সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার জোত আতাউল্লাহর বেপারীপাড়ায় সুফিয়া বেওয়া সূর্যোদয়ের পরপরই ঘানি ঠিকঠাক করে তাতে সরিষা ভরে দিচ্ছেন ঘানিতে। পরে নিজেই ঘানি টানা শুরু করেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৫ থেকে ১০ কেজি সরিষা ভাঙেন তিনি। ১০ কেজি ঘানি টেনে তেল বের করতে সময় লাগে তার ৬ ঘণ্টা। তবে বয়স বেশি হওয়ায় পাশের বাড়ির এক নারীকে নিয়েছেন সহযোগিতার জন্য। এতে যে টাকা পান সেখান থেকে তার সহকারীকে দিতে হয় অর্ধেক টাকা।

স্থানীয়রা জানান, ঘানি টানা খুবই কষ্টসাধ্য কাজ। এই বয়সে এত কঠিন কাজটি করে সুফিয়াকে সংসার চালাতে হয়। সারা দিন ঘানি টেনে যা উপার্জন হয়, তাতে সংসার চলে না সুফিয়ার। তার সন্তানরা তাকে ভরণ-পোষণ দেয় না। এ ছাড়া তার উপায়ও নেই। অসুখ-বিসুখ হলে তাকে অন্যের কাছে সাহায্য-সহযোগিতা নিতে হয়। যদি একটা গরু থাকত তার, তাহলে এই অমানবিক কষ্ট করতে হতো না।

সুফিয়া বেওয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, দিনে ৫ থেকে ১০ কেজি সরিষা ভাঙাতে পারি। তবে এই বয়সে ঘানি টানতে পারি না। পাশের বাড়ির একজনকে নিয়েছি সহযোগিতার জন্য। সে জন্য তাকে দৈনিক আয়ের অর্ধেক টাকা দিতে হয়। যে টাকা উপার্জন হয়, তাতে তিন বেলাই ঠিকমতো খেতে পারি না, ওষুধ কিনব কীভাবে?

পায়ের ব্যথা নিয়ে ভুগছেন সুফিয়া বেওয়া। তিনি বলেন, পায়ে অসয্য ব্যথা হয়। তাই আগের মতো ঘানি টানতে কষ্ট হয়। সন্তানরাও খোঁজখবর নিচ্ছে না। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। তাদের অবস্থাও তেমন ভালো না। এই বাড়িটি ছাড়া আমার আর কোনো জমিজমা নেই।

এ বিষয়ে মির্জাপু‌র ইউ‌নিয়‌নের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সংর‌ক্ষিত ইউ‌পি সদস্য নাস‌রিন কামাল ব‌লেন, ব্যক্তিগত ও ইউনিয়ন প‌রিষদ থে‌কে সব ধর‌নের সহ‌যো‌গিতা করা হ‌য়ে‌ছে তা‌কে। এছাড়া তা‌কে ১০ কে‌জি চাল কর্মসূচির কার্ড ক‌রে দেয়া হ‌য়ে‌ছে।

গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএও) মো. পারভেজ মল্লিক বলেন, হতদরিদ্র সুফিয়ার বিষয়টা আগে কেউ জানায়নি। আপনাদের মাধ্যমে জানতে পারলাম। খোঁ নিয়ে তাকে বিধবা কার্ড করে দেওয়াসহ সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

এনএ